ধান বিক্রিতে দুর্নীতি রুখতে শুধু ক্যামেরায় নজরদারি নয়, চাষি যাতে খুব দ্রুত ধান বিক্রির টাকা পেয়ে যান সেই জন্য অনলাইন মানি ট্রান্সফার সিস্টেমও চালু হল বীরভূমে। রাজ্য সরকারের ২১টি সহায়ক মূল্যের ধান ক্রয়কেন্দ্র ছাড়াও, সহায়ক মূল্যে ধান কিনছে সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি ও মহিলা সঙ্ঘ সমবায় মিলিয়ে আরও শতাধিক ক্রয়কেন্দ্র।
জেলার ১৩টি কিসান মান্ডি-সহ ২১টি সহায়ক মূল্যের ধান ক্রয়কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার নজরদারি চালানোরও প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, ইতিমধ্যেই ১১টি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। দু-তিন দিনের মধ্যে অন্যগুলোতেও সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। চাষি ছাড়া অন্য কেউ সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন কী না অথবা কেন্দ্রগুলোতে বারবার একই মুখের দেখা মিলছে কী না সেটা নিশ্চিত হতেই এমন পদক্ষেপ প্রশাসনের। কিন্তু তাতেও জেলার চাষিদের সমস্যা মিটছে না বলেই অভিযোগ। চাষিদের অনেকেই জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না তাঁরা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে জেলায় মোট চাষির সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ১১ হাজার ৫৬১জন। যদিও পরিবার ভেঙে, জমি বিভাজিত হয়ে সেই সংখ্যাটা বাস্তবে অনেক বেশি। কিন্তু সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয় কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছেছেন ও ধান বিক্রি করেছেন এমন চাষির সংখ্যা মাত্র ২৮ হাজার ৩০৭জন। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ধান কেনা হয়েছে ৯৮ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন। পরিসংখ্যানের নিরিখে চাষি ও ধান কেনার মাত্রা অনেকটাই কম। জেলার বিভিন্ন প্রান্তের চাষিদের কথায় সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন শুধুমাত্র বড় চাষিরাই। দুবরাজপুর, খয়রাশোল, মহম্মদবাজার, সিউড়ি, লাভপুর-সহ নানা এলাকার অধিকাংশ ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি, বর্গাদার, পাট্টাদারেদের অভিযোগ, তাঁদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ফড়ে বা দাললকেই। ৩১ ডিসেম্বর বা ১ জানুয়ারিতে তাঁদের বিক্রিত ধানের দাম ঘোরাফেরা করেছে ১৩৩০টাকা থেকে ১৪০০টাকার মধ্যে। যা সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেকটা কম।
জেলা প্রশাসন ও খাদ্য দফতরের কর্তাদের দাবি, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। ধান কেনার লক্ষ্য মাত্রার নিরিখে বীরভূমে এখনও পর্যন্ত ধান কেনার গতি আশানুরূপ। প্রশাসনের তথ্য বলছে, সহায়ক মূল্য ১৭৫০টাকা। চাষিরা নিজে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ফসল বিক্রি করলে ক্যুইন্টাল পিছু আরও ২০টাকা ভাতা দেওয়া হবে। শুধু ২১টি কেন্দ্র থেকেই নয়, ধান কিনছে কৃষি সমবায় সমিতিগুলি। জেলা সমবায় দফতর সূত্রের খবর এখনও পর্যন্ত মোট ১০০টি কৃষি সমবায়কে এবং ৩৩টি মহিলা সঙ্ঘ সমবায়ের ধান কেনার জন্য সরকারি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনেছে সমবায়গুলি। খুব তাড়াতাড়ি আরও ৪৫টি সমবায়কে নতুন করে ধান কিনতে বলা হবে। কিন্তু এত সুযোগ থাকতেও কেন কম টাকায় ফড়েদের ধান বিক্রি করছেন চাষিরা?
চাষিদের বক্তব্য, জেলার ১৬৭টি পঞ্চায়েতে যে ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। প্রান্তিক চাষিরা তাঁদের জমির সামান্য কয়েক বস্তা ধান নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ১০-১৫ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে মান্ডি বা ক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে পোষাচ্ছে না। কিসান মান্ডিতে গেলেও প্রায় ১০ কিলো ধান বাট্টা হিসেবে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ১ ক্যুইন্টাল ধান বয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ৯০ কিলো ধান। সঙ্গে সঙ্গে টাকা না পাওয়ার সমস্যাও আরেকটা কারণ।
দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক চাষি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর, আধার কার্ড নম্বর ও ছবি দিয়েছেন। দালালেরা সেগুলির সুযোগ নিয়ে শর্ত দিয়েছে কিসান মান্ডিতে ধান বিক্রির টাকা ঢুকলে সেখান থেকে পরিশোধ করতে হবে চাষিদের। কোনও কোনও দালাল আবার বাড়ির দরজায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছেও যাচ্ছে। কিছু বড় চাষিও দালালের ভূমিকায় নেমেছেন।
জেলা খাদ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘ধান বিক্রি করতে গেলে ধান বাদ দিতে হচ্ছে এই তথ্য সঠিক নয়। আর যিনি ধান বিক্রি করছেন ক্রয়কেন্দ্রে এসে তাঁকেই সই করতে হয়। নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রে সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে।’’