রাস্তায় ছাড়া গরু, যান চলাচলে বিপত্তি পুরুলিয়ায়

বাসস্ট্যান্ডের কাছে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন শিক্ষক সংগঠনের এক নেতা। বলা নেই কওয়া নেই আচমকা পিছন থেকে জোর ধাক্কা। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। হাত থেকে ছিটকে গেল মোবাইল। এমন বেতমিজ কাণ্ড একটি খামখেয়ালি গরুর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৭ ০৮:০৫
Share:

মাঝ-রাস্তায়: এই ছবিটাই চেনা হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়ার বাসিন্দাদের। নিজস্ব চিত্র

বাসস্ট্যান্ডের কাছে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন শিক্ষক সংগঠনের এক নেতা। বলা নেই কওয়া নেই আচমকা পিছন থেকে জোর ধাক্কা। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। হাত থেকে ছিটকে গেল মোবাইল। এমন বেতমিজ কাণ্ড একটি খামখেয়ালি গরুর।

Advertisement

পুরুলিয়া শহরের রাস্তাঘাটে এখন এমন অনেক গরুই দাপটের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে। সম্প্রতি রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে এসেছিলেন বৈঠক করতে। এক তলার করিডোর দিয়ে বেরনোর পথে তাঁরও চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বারান্দায় গ্যাঁট হয়ে বসে জিরোচ্ছে একটি গরু। সঙ্গে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও পড়েন বেজায় অস্বস্তিতে। হাসপাতালের ভিতরে গরু এল কী করে, স্বাস্থ্য অধিকর্তার এই অমোঘ প্রশ্ন চাপা পড়ে যায় শোরগোলে। হ্যাট হ্যাট করে এক সঙ্গে প্রায় সমস্ত কর্মী শশব্যস্ত হয়ে পড়েন গরুটিকে বের করতে।

কিন্তু হাসপাতাল তো না হয় হল, শহরের রাস্তায় ‘গরু নিয়ন্ত্রণ’ করবে কে? পুরুলিয়া শহরের মেন রোড, চকবাজার, চাইবাসা রোড, হাটের মোড়, কোর্ট মোড়, বাসস্ট্যান্ড, হাসপাতাল মোড়, জেলাশাসকের অফিস চত্বর, এমনকী জাতীয় সড়কের উপরে উড়ালপুলও এই বেওয়ারিশ গরুদের দখলে। সকালে ব্যস্ত সময়ে মানুষজন অফিস কাছারিতে ছুটে যাচ্ছে। এ দিকে রাস্তা জুড়ে এক এক জায়গায় বসে রয়েছে গরুরা। গাড়ির হর্ন, পথিকের হুশহুশ— কোনও কিছুতেই তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।

Advertisement

চাইবাসা রোডের দোকানদার ভোলানাথ সেনের কথায়, ‘‘আমার দোকানের সামনে তো কখনও কখনও একাধিক গরু এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় যানজটও হয়।’’ বড় হাটের এক আনাজ বিক্রেতা বলেন, ‘‘প্রতিদিন সকালে হাটে অনেকগুলো গরু আসে। লাঠি রাখি দোকানে, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয় না। আনাজ না দিলে তারা নড়বেই না।’’ আমডিহা এলাকার বাসিন্দা হেমন্ত মাহাতো শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘‘হাটের বাইরে সরু একটা রাস্তা। সকালে ভিড় থাকে। এক দিন হঠাৎ দেখি, হেলতে দুলতে একটা গরু সেই রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। কারও ব্যাগ থেকে কলাটা, মুলোটা, কোনও দোকান থেকে শাকের আঁটি চলতে চলতে দিব্যি মুখে পুরে নিচ্ছে।’’

ভিড় রাস্তায় গরুগুলি অবশ্য সারাক্ষণ থাকে না। এই কিছু দিন আগের কথা। পরের দিন সকালে সিএবি-র ম্যাচ। মানভূম ক্রীড়া সংস্থার কর্মীরা শহরের হিলভিউ মাঠের পিচে জল দিয়ে রোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভয় সেই গরুদেরই। ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট সাব কমিটির সদস্য রাণাপ্রতাপ সিংহ বলেন, ‘‘বাইরে থেকে যে সমস্ত জেলা আমাদের মাঠে খেলতে এসে অনেকেই পিচের খুব সুনাম করেন। কিন্তু গরুদের খুর থেকে পিচ কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখি, সেটা আমরাই জানি। একবার রোল করা পিচের উপর দিয়ে হেঁটে সেটার দফারফা করে দিয়েছিল কয়েকটা গরু।’’

পুরুলিয়া আরপিএফের ওসি নারায়ণ দত্তর দাবি, স্টেশন, রেললাইন সর্বত্র অবাধ গতিবিধি গরুদের। তিনি বলেন, ‘‘আমরাই একাধিকবার ট্রেনের ধাক্কায় আহত গরু উদ্ধার করে গোশালাতে দিয়ে এসেছি। যাঁদের গরু তাঁদের তো সামলে রাখা উচিত। নিরীহ প্রাণিগুলি খামোখা কষ্ট পায়। পুরসভার এই সমস্যা নিয়ে ভাবা দরকার।’’ জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক প্রতিভারঞ্জন সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘পথেঘাটে গরু ছাড়া থাকায় যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। এই সমস্যার কথা আমরা পরিবহণ দফতরে জানাব।’’

কিন্তু গৃহপালিত পশুগুলি রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে কেন? গোশালা কমিটির সম্পাদক রাজু রাজগড়িয়া বলেন, ‘‘শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেশির ভাগ গরুই কিন্তু বেওয়ারিশ নয়। তাদের মালিক রয়েছে। দিনভর শহরের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। রাতে ঘরে ফেরে।’’ পুরুলিয়ার প্রাক্তন পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগে তো পুরসভার নিজস্ব খোঁয়াড় ছিল। রাস্তার বেওয়ারিশ গরু সেখানে রাখা হতো। পরে মালিকেরা জরিমানা দিয়ে গরু ছাড়িয়ে নিয়ে যেতেন। সেই খোঁয়া়ড় বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক দিন। তার পরে এই সমস্যা নিয়ে শহরের গোশালা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বার বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা আর বেশিদূর এগোয়নি।’’

সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন পুরুলিয়ার পুরপ্রধান সামিমদাদ খান। তিনি বলেন, ‘‘আমরা পুলিশ ও গোশালা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই সমস্যা নিয়ে বৈঠকও করেছি। পুলিশ বলছে, বেওয়ারিশ গরু নিয়ে তাঁদের কোনও দায় নেই।’’

গোশালা কমিটির সম্পাদক রাজুবাবু বলেন, ‘‘গরুর মালিকেরা এই সমস্যা নিয়ে গা করেন না। এতে প্রাণিগুলোও কষ্ট পায়, সাধারণ মানুষেরও সমস্যা হয়। আমরা পুরসভাকে বলেছি আমাদের গরু রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হোক। আর একটা গাড়ি দেওয়া হোক। বেওয়ারিশ গরু নিয়ে গিয়ে আমাদের কাছে রাখব। ছাড়াতে এলে মালিককে জরিমানা দিতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন