দিদির দেহ আগলে তিন বোন

বিছানার উপরে পড়ে রয়েছে দিদির পচনধরা দেহ। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ির বাইরে। কিন্তু হুঁশ নেই বাড়িতে থাকা তিন বোনের। সেই দেহের পাশেই তাঁরা ঘুমোচ্ছিলেন। চলছিল খাওয়া-দাওয়া, দৈনন্দিন কাজকর্মও। শেষে পড়শিদের নাকে দুর্গন্ধ যেতে জানাজানি হল ঘটনাটি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০১:৫৭
Share:

এই বাড়িতেই মিলেছে দেহ। নিজস্ব চিত্র

বিছানার উপরে পড়ে রয়েছে দিদির পচনধরা দেহ। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ির বাইরে। কিন্তু হুঁশ নেই বাড়িতে থাকা তিন বোনের। সেই দেহের পাশেই তাঁরা ঘুমোচ্ছিলেন। চলছিল খাওয়া-দাওয়া, দৈনন্দিন কাজকর্মও। শেষে পড়শিদের নাকে দুর্গন্ধ যেতে জানাজানি হল ঘটনাটি। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে বৃদ্ধার দেহ উদ্ধার করল।

Advertisement

বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগান এলাকায় এমনই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়ি থেকে পুলিশ মৃতার দেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতার নাম অর্চনা পাল (৬০)। তিন বোন টুকটুক, লিলি ও তপতীদের সঙ্গে তিনি প্রতাপবাগানের বাড়িতে থাকতেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, মৃত্যুর পরে অন্তত দেড় দিন অর্চনাদেবীর দেহ ওই ঘরেই পড়ে ছিল। শুক্রবার দেহটির ময়না-তদন্ত করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, অর্চনাদেবীর তিন বোনই মানসিক রোগী। মৃতদেহ উদ্ধারের পরে ওই তিন বোনকেও পুলিশ উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য বাঁকুড়া মেডিক্যালে পাঠায়। এ দিন টুকটুকদেবী ও লিলিদেবী বাড়ি ফিরে এলেও তপতীদেবী হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে অর্চনাদেবীর মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

Advertisement

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অর্চনাদেবীদের বাবা ভজহরি পাল রাজ্য সরকারের কর্মী ছিলেন। তাঁর পাঁচ মেয়ে। বছর কুড়ি আগে ভজহরিবাবু মারা যান। বছর দশেক আগে মারা যান অর্চনাদেবীদের মা। তখনও মৃত মায়ের দেহ বাড়ির মধ্যেই রেখে দিয়েছিলেন অর্চনাদেবীরা। ওই ঘটনার কয়েক বছর পরে তাঁদের আরও এক বোন মারা যান।

স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, অর্চনাদেবীদের পরিবারে আর্থিক সমস্যা ছিল না। অর্চনাদেবী নিজেই বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও কাজে যুক্ত ছিলেন। তবে দীর্ঘ দিন সেই কাজ থেকেও তিনি অবসর নেন বলেই জানা গিয়েছে। চার বোনের মধ্যে কেউই বিয়ে করেননি। বেশির ভাগ সময় তাঁরা বাড়িতেই থাকতেন। পড়শিদের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি কথা বলতেন না। তাঁদের জীবনযাপনও স্বাভাবিক ছিল না বলেই জানাচ্ছেন পড়শিরা।

প্রতাপবাগানের মুদি দোকানি নিমাই দত্ত বলেন, “কোনও কোনও দিন দোকান বন্ধ করার সময় রাত ১০টার পরে রান্নার জন্য চাল কিনতে আসতেন ওই মহিলারা। মাঝ রাত পর্যন্ত তাঁরা রান্নাবান্না করতেন।” স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “বোনে বোনে প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। ঝামেলা হলে আমাকে এসে সমস্যার কথা জানাতেন তাঁরা।” অর্চনাদেবীদের পড়শি তথা মগরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র বলেন, “রাত দু’টো আড়াইটের সময়েও চিৎকার করে ঝগড়া করতেন ওই বোনেরা। অনেক সময় তাঁদের চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত।

স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “মৃত্যুর পরে বাড়িতে দেহ রেখে দেওয়া এ বারই প্রথম নয়। অর্চনাদের মা যখন মারা যান, তখনও দেহ বাড়িতে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। মৃত মাকে দেখিয়ে তাঁরা দাবি করেছিলেন, বেঁচে রয়েছে। প্রতিবেশীরা এক প্রকার জোর করেই দেহটি শ্মশানে নিয়ে যান।” মুকেশবাবু জানান, অর্চনার আগের বোনের দেহও একই ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। সে বারও দুর্গন্ধ ছড়ানোর পরে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন।

এ দিন প্রতাপবাগানের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আগাছা ভরা উঠোন। পেয়ারা, কাঁঠাল, আম গাছ বাড়িটি ঘিরে রেখেছে। ওই বাড়িতে মানুষ থাকে বলে দেখে বোঝাই দায়। দোতলার পাকা বাড়িটির ভিতরে উঁকি মেরে দেখা যায়, শুধু পুরনো জিনিসপত্র অগোছাল ভাবে পড়ে রয়েছে।

দুপুরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে লিলিদেবী ও টুকটুকদেবী পাড়ায় ফেরেন। এক পড়শির বাড়িতে তাঁরা গিয়েছিলেন কথা বলতে। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে উপস্থিত হতে দেখেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন তাঁরা। পরে তাঁরা কোনও রকমে দাবি করেন, ‘‘দিদি কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। আমরাই দিদিকে খাওয়ানো পরানো করছিলাম। বৃহস্পতিবার সকালে দিদির অসুস্থতা বেড়ে গেলে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে দিদিকে মৃত বলে জানানো হয়। তারপর অন্য একটি গাড়িতে করে দিদিকে বাড়ি নিয়ে চলে আসি।” সৎকার না করে ফেলে রেখেছিলেন কেন? এর সদুত্তর তাঁদের কাছে পাওয়া যায়নি।

দেহ উদ্ধার করতে যাওয়া কয়েকজন পুলিশ কর্মী জানাচ্ছেন, প্রথমে ঘরের দরজাই খুলতে চাননি তিন বোন। পরে বাড়ির পিছনের দিকের দরজা খোলেন। পুলিশ কর্মীরা সেই দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখেন তপতীদেবী মৃত দিদির ঘরেই অন্য একটি খাটে শুয়ে রয়েছেন। পুলিশ কর্মীরা দেহ উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে বাকি তিন বোনকেও থানায় নিয়ে যান। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাঁদের বাঁকুড়া মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।

জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেলেই অর্চনাদেবীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন