সচেতনতার অভাবকেই দুষছে জেলা পুলিশ, শিশুর মাথাও ফাঁকা

কয়েক ঘণ্টা পরেই বিয়ে। কাছের বন্ধুদের ডাকতে মোটরবাইক ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাত্র নিজেই। পথেই বেপরয়ো এক ট্রাকের সঙ্গে জোর ধাক্কা। হাসপাতাল অবধি ছোটার সুযোগও মেলেনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই যুবকের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:০৫
Share:

দুবরাজপুরে সাতকেঁদুরির কাছে।—নিজস্ব চিত্র

কয়েক ঘণ্টা পরেই বিয়ে। কাছের বন্ধুদের ডাকতে মোটরবাইক ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাত্র নিজেই। পথেই বেপরয়ো এক ট্রাকের সঙ্গে জোর ধাক্কা। হাসপাতাল অবধি ছোটার সুযোগও মেলেনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই যুবকের।

Advertisement

গত জুনে সিউড়ি শহরের অদূরে জাতীয় সড়কের ওই ঘটনাটি হয়তো এমন বাঁক নিতই না। সে দিন যদি ওই যুবকের মাথায় হেলমেট থাকত। অন্তত এমনটাই মনে করেন ট্রাফিক পুলিশের আধিকারিকেরা। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে দুর্ঘটনায় মোটরবাইক আরোহীর মৃত্যুর নেপথ্যে হেলমেট পরা নিয়ে সচেতনতার অভাবকেই দুষছেন তাঁরা। এমনকী, হেলমেট পরার ব্যাপারে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বিশেষ জোর দেওয়ার পরেও যে বীরভূমে ছবিটা পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে, তা-ও নয়।

যদিও ঘটনা হল, মাসখানেক আগেই ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচিকে ঘিরে নিয়মিত পুলিশি অভিযান ও প্রচারে হেলমেট পড়ার চল সত্যি সত্যিই একধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল। আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মোটরবাইক আরোহী হেলমেট ব্যবহারও শুরু করছেন। কিন্তু, অভিযান শুরু হওয়ার সময় সেই হার যে ভাবে বাড়ছিল, সামান্য ঢিলা পড়তেই, ফের তা নামতে শুরু করেছে। শুক্রবার সিউড়ি শহরে ঘুরে অন্তত তেমনটাই দেখা গেল। জেলার অন্যান্য শহর-মফস্সলের রাস্তাগুলিতে তো বটেই, জাতীয় সড়কেও একই ছবি বলে অভিযোগ। যত মোটরবাইক যাতায়াত করছে, তার একটা বড় অংশই নিয়ম মানছেন না। কোথাও একই মোটরবাইকে তিন জন আরোহী, অথচ কারও মাথায় হেলমেট নেই। কোথাও আবার যিনি মোটরবাইক চালাচ্ছেন, তাঁর মাথায় হেলমেট থাকলেও ফুয়েল ট্যাঙ্কের উপর বসে থাকা শিশু এবং পিছনে বসে থাকা স্ত্রীর মাথা শূন্য। কেউ কেউ তো চুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে হেলমেটটিকে মোটরবাইকে ঝুলিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন!

Advertisement

সিউড়ির হাটজনবাজার এলাকায় রেল ফটকে এ দিন দেখা মিলল এক স্কুটির। আরোহীর মাথা ফাঁকা, পায়ে চটি। তাঁর হেলমেটটি ঝুলছে লুকিং গ্লাসে। ফুয়েল ট্যাঙ্ক ও পা রাখার স্থানের অল্প খানিকটা জায়গায় আবার এক ব্যাগ রাখা। পিছনের সিটে বসে এক মহিলা। হেলমেট নেই তাঁর মাথাতেও। তাঁদের দু’জনের মাঝে কোনও রকমে বসে রয়েছে এক শিশু। মাথা খালি তারও! যা শুনে জেলা পুলিশের এক কর্তার ক্ষোভ, ‘‘পরিবারের লোকেদের চাপিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এমন ভাবে যাতায়াত করার কী মানে? প্রাথমিক ভাবে নিজেরাই যদি সচেতন না হন, হাজার আইন বানিয়েও সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।’’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিন দুয়েক আগের অপর একটি অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন দুবরাজপুর এলাকার এক যুবক। হেলমেট ছাড়াই এলাকার একটি পাম্পে পেট্রোল নিতে গিয়েছিলেন তিনি। পাম্পের কর্মী সামনের ‘হেলমেট ছাড়া পেট্রোল নয়’ বোর্ড দেখিয়ে পত্রপাঠ তাঁকে বিদায় করেন। তাঁর কথায়, ‘‘পাঁচ মিনিট পরেই পরিচিত এক যুবকের সঙ্গে পথে দেখা। ওঁর বাবা এলাকার রাজনীতিতে বড় নাম। ওই পাম্প থকেই তেল নিতে যাচ্ছিল। তা শুনে ওঁর মোটরবাইকেই চড়ে বসলাম।’’ এ বার আর তেল পেতে অসুবিধা হয়নি ওই যুবকের! ঘটনা হল, দুবরাজপুরের ওই পাম্পে তো তা-ও প্রভাবশালী নেতার ছেলে এবং তাঁর পরিচিতেরা ছাড় পাচ্ছেন, অন্যান্য জায়গায় হেলমেট ছাড়াই এখনও দিব্যি তেল মিলছে। কোথাও আবার নিয়ম ‘রাখতে’ অন্যের থেকে মিনিটখানেক হেলমেট ধার করে পাম্প থেকে তেল ভরাচ্ছেন কেউ কেউ।

শুধু দুবরাজপুরই নয়, সিউড়ি এবং অন্যান্য শহরগুলির পেট্রোল পাম্পের ছবিও খুব একটা আলাদা নয়। পাম্প মালিকদের একাংশ বলছেন, ‘‘আমরা প্রত্যেককে হেলমেট পরতে অনুরোধ করতে পারি, পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশ মেনে সচেতনতার বোর্ড ঝোলাতে পারি। কিন্তু আমরা তো আর লোকেদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারি না। আক্রান্ত হলে আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে?’’ অন্য দিকে, সিউড়ির এক হেলমেট বিক্রেতার দাবি, হেলমেট বিক্রি একলাফে কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু, বর্তমানে সেই সংখ্যাটা কমেছে।

পাম্প কর্মীদের অবশ্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন জেলার পুলিশ কর্তারা। অন্য দিকে, পুলিশি অভিযান কমেছে বলে হেলমেটহীন মোটরবাইক আরোহীদের সংখ্যা বাড়ছে— এমনটা মানতে নারাজ পুলিশ। তবে, এখনও যে সকলে হেলমেট ব্যবহার করছেন না, সে কথা মানছেন জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারাও। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘এক দিনে কি পাল্টে যাবে? সময় লাগবে। আমরা আমাদের সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রাথমিক ভাবে নিজের ভালটা সাধারণ মানুষকেও বুঝে নিতে হবে।’’ জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারও বলেছেন, ‘‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচি একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই উন্নতি হয়েছে। আমরা এখনও লেগে রয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন