(ছবি সৌজন্যে: স্বপনকুমার ঘোষ)
রতনকুঠির ঠিক সামনে হাঁড়ি, কলসি, মাটির প্রদীপ। মাটির ঘট। লাল রাস্তাজুড়ে খাটের উপর খাট। ওদিকে দরজায় দরজায় মাথা ঠোকাঠুকি। এ দিকে পাল্কিও আছে। রয়েছে টিনের তৈরি ছোট ছোট ধানের মড়াই। সেচের ডোঙা। তারই মধ্যে গোরুর গাড়ির ছই মাটিতে ফেলে শুয়ে-বসে আছে দোকানিরা— এই নিয়েই ‘তিনদিনের সংসার’।
জুঁই স্মৃতির পাতা উল্টে দেখা এ মেলার কথা, প্রথম যুগের শান্তিনিকেতন পৌষমেলার।
‘শান্তিনিকেতন থেকে’ এ মেলার শব্দ-ছবি ১৯৫৪-৫৫ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় মেলে। সম্প্রতি যে গ্রামীণ মেলার চরিত্র ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে, এ সেই হারানো মেলারই ছবি! সেকালের পত্র-পত্রিকা দেখলে বোঝা যায়, দিনে দিনে মেলার কত বদল! কবেই যেন বেড়ে গিয়েছে তার বহর। এক দিনের মেলা বাড়তে বাড়তে
চার দিনের!
একসময় উপাসনা মন্দিরের পাশের মাঠ থেকে মেলা সরে গিয়েছে পূর্বপল্লির মাঠে। নীলকণ্ঠ মুখুজ্জের যাত্রাগান, উদাত্ত বাউল-ফকির-দরবেশি সুর, কুয়াশা রাত কেটে কেটে কীর্তনের বিস্তার কবেই স্মৃতি। গ্রাম্য মেলার মিঠে লোকসুরে মিশে গিয়েছে সার্কাস সরণি আর ফুচকাপট্টির ডিজে কোলাহল!
কেমন ছিল প্রথম যুগের মেলা?
ইতিহাস বলছে, এ মেলার শুরুর গল্প শান্তিনিকেতনে নয়। কলকাতার কাছেই গোরিটির বাগানে।
১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করলেন, দীক্ষিত ব্রাহ্মদের নিয়ে একটি মেলা করবেন। নিজের আত্মজীবনীতে লিখছেনও সে স্মৃতি। ‘‘পরস্পরের এমন সৌহার্দ্য দেখিলাম, তখন আমার মনে বড়ই আহ্লাদ হইল। আমি মনে করিলাম যে, নগরের বাহিরে প্রশস্ত ক্ষেত্রে ইঁহাদের প্রতি পৌষমাসে একটা মেলা হইলে ভাল হয়।’’ ১৮৪৫-এর ৭ পৌষ, সে মেলা বসল গোরিটির বাগানে। সে মেলার ১৭ বছর পরে বোলপুরে জনবিরল প্রান্তরের মধ্যে দুটি নিঃসঙ্গ ছাতিম গাছের তলায় মহর্ষি সন্ধান পেলেন তাঁর শান্তিনিকেতনের। রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে সে শান্তির আশ্রয় মৌরসীস্বত্বে কিনেও নিলেন তিনি। ট্রাস্টডিডে লিখলেন, ‘‘ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাষ্টীগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসাবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করিবেন।’’
শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা প্রথম বসল ১৮৯৪ সালে, ৭ পৌষ, মন্দিরের পাশের মাঠে ও ছাতিমতলার ছায়ায়।
সে মেলার চমৎকার ছবি মেলে সেকালের পত্র-পত্রিকায়। ‘‘সর্বপ্রথমে ঘণ্টারব। তখন সকলে ব্রহ্মোপসনার জন্য প্রস্তুত হইলেন এবং শ্রদ্ধাস্পদ বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অগ্রবর্তী করিয়া মঙ্গলগীত গাহিতে গাহিতে মন্দির প্রদক্ষিণ করিলেন।’’ উৎসবে ছিলেন, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। লোক শিক্ষের জন্য সে বার রাজা হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান গীত হয়েছিল। সন্ধেয় উপাসনার পরে পোড়ানো হয় আতসবাজি!
এমন মিঠে স্মৃতিতে সর্বাঙ্গ জড়ানো এ মেলার। রবীন্দ্রনাথের নিজের প্রবন্ধ, ভাষণ, চিঠিতেও ছড়িয়ে মেলার হাজার-কথা।
একবার রবীন্দ্রনাথ পৌষমেলার সময় শান্তিনিকেতনে নেই। প্রবাসে। আমেরিকার ৫০৮, ডবলিউ-হাই স্ট্রিট থেকে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখছেন, ‘‘আজ ৭ই পৌষ। ... কাল রাত্রে ঘুম থেকে প্রায় মাঝে-মাঝে জেগে উঠে ব্যথা বোধ করছিলুম, স্বপ্ন দেখলুম, তোমাদের সকালকার উৎসব আরম্ভ হয়েছে। আমি যেন এখান থেকে সেখানে গিয়ে পৌঁছেছি, কিন্তু কেউ জানে না। তুমি তখন গান গাচ্ছ, ‘জাগো সকল অমৃতের অধিকারী’। আমি মন্দিরের উত্তর বারান্দা দিয়ে আস্তে আস্তে ছায়ার মতো যাচ্ছি তোমাদের পিছনে গিয়ে বসব, তোমরা কেউ কেউ টের পেয়ে আশ্চর্য হয়ে উঠেছ। এমনতরো সুস্পষ্ট স্বপ্ন আমি অনেকদিন দেখিনি, জেগে উঠে ঐ গানটা আমার মনে স্পষ্ট বাজতে লাগল। হায়রে, এদেশে কি তেমন সকাল হয় না?’’
তিনি যখন শান্তিনিকেতনেই, তখনও মেলা নিয়ে তাঁর নিত্য আগ্রহ। ‘প্রিয় রাণু’কে লিখছেন তার স্কুলের প্রাইজের মজার খবরের জবাবে, ‘‘তোমাদের প্রাইজে কত লোক জমা হয়েছিল? পঞ্চাশ জন? কিন্তু আমাদের এখানে মেলায় অন্ততঃ দশ হাজার লোক তো হয়েইছিল।... এখানকার মাঠে যা চিৎকার হয়েছিল তাতে কত রকমেরই আওয়াজ মিলেছিল, তার কি সংখ্যা ছিল। ছোটো ছেলের কান্না, বড়োদের হাঁকডাক, ডুগডুগির বাদ্য, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ, যাত্রার দলের চিৎকার, তুবড়িবাজির সোঁ সোঁ, পটকার ফুটফাট, পুলিশ-চৌকিদারের হৈ হৈ, হাসি, কান্না, গান, চেঁচামেচি, ঝগড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।’’
ভোর থেকে রাত হরেক মজায় মোড়া ছিল সেকালের মেলা। কত যে তার রং! গানে গানে গাঁথা পৌষের প্রহর।
সে যুগের প্রাক্তনী প্রমথনাথ বিশীর স্মৃতি, ‘‘সন্ধ্যার সময়ে মেলার ভিড় এত বাড়িয়া উঠিত যে, তাহা সংযত করার সাধ্য রায়পুরের রবিসিংহ ছাড়া আর কাহারো ছিল না। হাঁ, জনতা সংযত কবিবার মতো চেহারা বটে! রবিসিংহের ধুতি লাল, চাদর লাল, পাগড়ি লাল, চক্ষুদুটোও যেন লাল। পুলিশের তো শুধু পাগড়ি লাল। এই শক্তি-পুরুষ বেত হাতে সপাসপ জনতাকে আঘাত করিয়া চলিয়াছেন, জনতা শশব্যস্ত হইয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতেছে।... রবিসিংহ আধুনিক ডিরেক্টরদের অখ্যাত পূর্বপুরুষ।’’
আরেক প্রাক্তনী, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা লিখছেন, ‘‘৭ই পৌষের ভোর চারটায় দিনেন্দ্রনাথের পরিচালনায় বৈতালিক গানের দল গান গেয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ করত। দিনুবাবুর দরাজ কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসত সকলের মিলিত কণ্ঠস্বরের ঊর্ধ্বে। আমরা কয়েকজন উৎসাহী ছাত্র বৈতালিকের আগেই শেষ রাত্রির অন্ধকারে কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করে নিতাম।’’
আশ্রম সদস্য গৌতম ভট্টাচার্যের ‘পৌষ উৎসব’ সংকলন বা পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা’ পাতায় পাতায় হাজির এমন সব মেলা-স্মৃতির নানান কাহিনি।
কেউ কেউ বলেন, সেই স্মৃতি বা পরের কয়েক দশকের স্মৃতির পাশে ঠিক মেলানো যায় না এখন মেলা। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক স্বপনকুমার ঘোষ যেমন বলছিলেন, ‘‘সত্তরে যে মেলা প্রথম দেখেছি, তার পরিবেশ ঘরোয়া ছিল। ছাতিমতলায় ৭ পৌষের
উপাসনা এখনও স্মৃতিতে।
ওই কনকনে ঠান্ডায় দেখেছি শান্তিদেব ঘোষ, মোহরদিকে। তাঁদের গান আজও কানে বাজে। মেলায় কত জন যে আসতেন। অমর্ত্যদা, জর্জদা, সুচিত্রা মিত্রদের দেখেছি কালোর দোকানে। সকলের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে মিশতেন। এখন তো দূরত্ব!’’
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, তাঁর দেখা গত ২৪-২৫ বছরে পৌষমেলা আলাদা করে খুব বদল হয়নি। মানব বলেন, ‘‘পুরনো ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘শান্তিনিকেতন পত্রিকা’ বা সেকালের আশ্রমিকদের স্মৃতিকথায় যে মেলার বিবরণ পাই তাতে বুঝতে পারি একশো বাইশ বছরে মেলার চরিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তবে এই বদলটা বুঝতে গেলে পারিপার্শ্বিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তমান চরিত্রটাও স্মরণে রাখতে হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ‘ধর্ম্মভাব উদ্দীপনের জন্য’ মেলার প্রস্তাব করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের কাছে মেলা ছিল মানুষে-মানুষে আন্তরিক যোগ-সাধনের উপলক্ষ। পৌষ-উৎসবের যে আত্মিক উপলব্ধির দিক তার আনুষঙ্গিক লৌকিক মূর্তি ছিল পৌষমেলা। ক্রমে এই উপলক্ষটাই হয়ে উঠল লক্ষ্য!’’
শুধুই স্মৃতির মেলা, তিন দিনের স্মৃতির সংসার! এমনও হয়!
‘‘স্মৃতিই তো! বদলে গিয়েছে রঙ ও রেখা, তবু কত স্মৃতি যে খেলা করে! যেই না পৌষের হাওয়া দিল উত্তর থেকে, কিংবা প্রথম দোকানের খুঁটি পোঁতা হল মেলার মাঠে মনজুড়ে কত ছবি! কলকাতা আর্ট কলেজের কত শিল্পীকে দেখতাম, এসে মেলায় ছবি আঁকছেন। ছবিগুলো আছে, ফিকে রং’’— বলছিলেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারী। তাঁর সংযোজন, ‘‘এ মেলাবাহিরকে আপন করে নেওয়ার মেলা। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান করবে’, ঠিক সেই।’’