রোগী দেখছেন শল্যচিকিৎসক পবন মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
কোথাও চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানের অভাবে বহুমূল্যের যন্ত্র পড়ে থাকে তালা বন্ধ ঘরে। কোথাও চিকিৎসক থাকলেও উন্নত চিকিৎসার যন্ত্র মেলে না। কিন্তু ব্যতিক্রম পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল। ল্যাপারোস্কোপি অস্ত্রোপচারের যন্ত্র (স্বল্পক্ষত চিকিৎসা) আসার পরে এখানে রীতিমতো সাফল্যের সঙ্গে কাজ চলছে। শুধু এই জেলারই নয়, বাইরে থেকেও অনেকে এখানে স্বল্পক্ষত অস্ত্রোপচার করাতে আসছেন। তাঁদের ভরসা হয়ে উঠেছেন শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডল ও তাঁর সঙ্গী চিকিৎসকেরা।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অনিলকুমার দত্ত বলছেন, ‘‘পবনবাবু নিজের দায়বদ্ধতা বারবার প্রমাণ করেছেন। এই হাসপাতালের সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে তিনি অনেক জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন।’’
পুরুলিয়ার চিড়কার বাসিন্দা সত্তর বছরের মণি কুমারের পিত্তথলি ও পিত্তনালিতে প্রচুর পাথর জমে ছিল। পবনবাবু ঝুঁকি নিয়ে তিন চিকিৎসক স্নেহাংশু কলা, মহম্মদ গফুর আহমেদ ও সুমন চক্রবর্তীর সঙ্গে গত মার্চ মাসে সেই বৃদ্ধার পেট থেকে ১,১১৫টি পাথর বার করেন। সেই ঘটনায় অনেকেই তাজ্জব হয়ে যান।
শুধু ল্যাপারোস্কোপিই নয়, অনেক জটিল অস্ত্রোপচারও তিনি করেছেন এই জেলা হাসপাতালেই। বেশ কয়েক বছর আগে পথ দুর্ঘটনার পুরুলিয়া শহরের এক বাসিন্দার আঙুল কেটে যায়। পবনবাবু সেই রোগীর কাছে কাটা আঙুলের টুকরো দেখতে চেয়েছিলেন। রাস্তার ধুলো থেকে তুলে আনা হয় আঙুলের টুকরো। অস্ত্রোপচার করে জোড়া লাগান পবনবাবু।
তারও আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে সাঁওতালডিহি এলাকার এক কিশোরের তলপেটে কাস্তে ঢুকে যায়। এত রক্তক্ষরণ হয়, যে তখনই অস্ত্রোপচার না করা গেলে কিশোরের প্রাণ সংশয় হতে পারত। দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তার প্রাণ বাঁচান পবনবাবু। এমনকি মাঝ রাতে হাসপাতালের ফোন পেয়ে ঘুম থেকে উঠে তিনি এক যুবকের তলপেটে বিঁধে থাকা ছুরি ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় বার করে আনেন।
একের পর এক জটিল অস্ত্রোপচার ২০১৪ সালে তাঁকে রাজ্য সরকারের ‘বঙ্গ চিকিৎসক’ সম্মান এনে দেয়। সেই বছরেই পুরুলিয়ায় চালু হয় ল্যাপারোস্কোপি। দায়িত্ব পান পবনবাবু। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রঘুনাথপুর হাসপাতালেও এই অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। সেখানকার দায়িত্বেও পবনবাবু।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘এক সময়ে পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালে অনেক জটিল অস্ত্রোপচারের রোগীকেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু সাহস করে অস্ত্রোপচার করে রোগীদের ভরসা ফিরিয়েছেন পবনবাবু।’’
বেশ কয়েক মাস আগে উল্টোডাঙার বাসিন্দা শ্যামলী সাহা পুরুলিয়ায় এসে পবনবাবুর কাছে পিত্তথলি অস্ত্রোপচার করে পাথর বের করেন। তাঁর দিদি দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের ডেপুটি নার্সিং সুপার চিন্তামণি পোদ্দার বলেছিলেন, ‘‘কলকাতার হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের দিন পাওয়া যাচ্ছিল না। পুরুলিয়ায় ল্যাপারোস্কোপি খুব ভাল হচ্ছে শুনে বোনকে ভরসা দিয়ে এখানে আসতে বলি।’’ তাঁর মতোই আদতে পুরুলিয়ার দুবড়ার বাসিন্দা, বর্তমানে দিল্লিবাসী মহম্মদ রঞ্ঝা তাঁর স্ত্রীর পিত্তথলির পাথরের অস্ত্রোপচার করান এখানে। পশ্চিম মেদিনীপুরের লোধাশুলির বাসিন্দা কাজল পাতর বলেন, ‘‘শুধু অস্ত্রোপচার করেই ছেড়ে দেন না। পবনবাবু পরে ফোন করে কেমন আছি, সেই খোঁজও নিয়েছিলেন। ক’জন চিকিৎসক আজকের দিনে এমনটা করেন?’’
পূর্ব মেদিনীপুরের আড়ংকেরানা গ্রামের চাষি পরিবারের সন্তান পবনবাবুর ২০০৭ সালে জয়পুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ দিয়ে পুরুলিয়ায় আসা। পবনবাবু যখন ডাক্তারি পড়ছেন, সেই সময় তাঁর বাবা মারা যান। তিনি ছেলেকে বলেছিলেন, গরিব মানুষের সেবা করতে। পবনবাবুর কথায়, ‘‘পুরুলিয়া হাসপাতালে এমন অনেক মানুষের দেখা পাই, যাঁরা অসহায়। গুরুতর অস্ত্রোপচার জেনেও যাঁরা বলেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনিই যা করার করুন। আমাদের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই’।’’
তবে সহকর্মীদের সহায়তার কথা বারবার বলেছেন তিনি। পবনবাবুর কথায়, ‘‘ওঁরা পাশে না থাকলে আমি কি কাজ করতে পারতাম?’’