সাঁওতালি নন্দিনীকে দেখে বিস্ময় কল্পনার

শান্ত জঙ্গলে বাতাসে সুর খেলে। রবি ঠাকুরের সুর। কথাগুলো অচেনা। শালবনের মধ্যে খোলামঞ্চে ফতুয়া আর ধুতি পরা একটি লোক গেয়ে চলেছে, ‘আমেএম জতেৎ কিডিং আ/ ইঞ সুখ ইঞ য়াম কেদা/ আমেএম চুকু এন সারি/ মেদ-দাৎ তে আতু হেৎ এন’। যার বাংলা মর্মার্থ করলে ‘রক্তকরবী’র চেনা গানটা কানে ভাসে— ‘আমার কাজের মাঝে মাঝে কান্না ধারার দোলা তুমি থামলে দিলে না যে’।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

ইলামবাজার (দ্বারোন্দা) শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৫১
Share:

আদিবিম্ব উৎসবে সাঁওতালি নাটক ‘আরাবাহা’র একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র

শান্ত জঙ্গলে বাতাসে সুর খেলে। রবি ঠাকুরের সুর। কথাগুলো অচেনা। শালবনের মধ্যে খোলামঞ্চে ফতুয়া আর ধুতি পরা একটি লোক গেয়ে চলেছে, ‘আমেএম জতেৎ কিডিং আ/ ইঞ সুখ ইঞ য়াম কেদা/ আমেএম চুকু এন সারি/ মেদ-দাৎ তে আতু হেৎ এন’। যার বাংলা মর্মার্থ করলে ‘রক্তকরবী’র চেনা গানটা কানে ভাসে— ‘আমার কাজের মাঝে মাঝে কান্না ধারার দোলা তুমি থামলে দিলে না যে’। বিশু পাগল গেয়ে চলছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে নন্দিনী। বড় চেনা ছবি। বড় মন ছুঁয়ে যাওয়া সেই দৃশ্য। নাটকের মঞ্চ ছাড়া শুধু অনুভবে যার দেখা মেলে।

Advertisement

শালবনের মঞ্চে নাটক শেষ হয়।

অসমের লালুকের পদ্মপুর দেউরি গাঁওয়ের কল্পনা দেউরি আর ইলামবাজারের কামারপাড়ার লক্ষ্মী কিস্কু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন। আবার হয়তো এক বছর পরে, হয়তো বা কখনওই নয়। তবু কল্পনা আর লক্ষ্মী দু’জনেরই স্বপ্নটা এক। ইচ্ছেগুলো এক। ভাষা, সমাজ, রীতি-নীতি সব আলাদা হলেও ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী চরিত্রে লক্ষ্মীকে দেখে কল্পনার চোখের কোণে জল চিকচিক করে। রাজার নজরদারিতে ‘বাধ্য’ জীবনে রঞ্জনের স্বপ্ন দেখে নন্দিনী। রঞ্জন নন্দিনীর জীবনে ভাল থাকার স্বপ্ন। মুক্তির আনন্দ।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তে রাজা বা রঞ্জন কল্পনার চরিত্র। বৃহস্পতিবার বীরভূমের ইলামবাজারের দ্বারোন্দায় আদিবাসী ‘আদিবিম্ব’র মঞ্চে সাঁওতালি ভাষায় ‘রক্তকরবী’ অবলম্বনে ১৭ জন সাঁওতাল ছেলেমেয়ের অভিনীত নাটক ‘আরাবাহা’য় রাজা ও রঞ্জন কিন্তু বাস্তব। কঠিন বাস্তব আর স্বপ্নের এই লড়াইয়ে স্বপ্নের জয় হয় ‘রক্তকরবী’র মতোই। কিন্তু, স্বপ্নের মানুষটিকে হারাতে হয় নন্দিনীকে। রক্তাক্ত যক্ষপুরীতে রঞ্জনের বানামটা (তারের তৈরি সাঁওতালি বাদ্যযন্ত্র) পড়ে থাকে শুধু। মৃত্যুপুরীতে জীবন্ত থাকে শুধু লালফুলের গাছ। সাঁওতালি ভাষায় তারই নাম আরাবাহা। ওই লালফুলই নতুন স্বপ্ন দেখায়। এই নাটকে নন্দিনীর কাছে রঞ্জন বাঁচে আরাবাহা হয়ে।

শান্তিনিকেতনের পুণ্যিদেবী কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী লক্ষ্মী কখনও ‘রক্তকরবী’ পড়েনি। জীবনে প্রথম অভিনয় করতে গিয়ে ‘বীরভূম ব্লসম থিয়েটারে’র পরিচালক এবং এই নাটকের নির্দেশক পার্থ গুপ্তর কাছে প্রথম ‘রক্তকরবী’র গল্প শুনেছেন। সমাজ-ব্যবস্থার জাঁতাকলের বিরুদ্ধে শান্ত নন্দিনীর প্রায় নিঃশব্দ লড়াই আরাবাহার লক্ষ্মীরও। চাষি পরিবার। নিজেদের জমি নেই। ফসল না ফললে দু’বেলা খাবার জোটে না। ফললেও দাম মেলে না। অবস্থা বদলায় না। খিদের লড়াই, উপার্জনের লড়াই, সম্মানের লড়াই— লড়াই যেন নিজের সঙ্গেও। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়তে যাওয়াটাই লক্ষ্মীদের কাছে সংগ্রামের মতো। সমাজের চিরায়ত আর অদৃশ্য প্রাচীর ঘেরা গণ্ডির বাইরে বের হতে চাওয়া নন্দিনী যেন লক্ষ্মী, কল্পনার মতো অসংখ্য আদিবাসী মেয়ের জীবনের প্রতিচ্ছবি।

‘আরাবাহা’র এই প্রযোজনা নজর কেড়েছে ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’র চেয়ারম্যান তথা বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামেরও। রতন নিজে রবি ঠাকুরের অসংখ্য নাটক নিয়ে কাজ করেছেন। সাঁওতালি ভাষায় এই প্রথম বার আদিবাসী সংস্কৃতির উৎসবে রবি ঠাকুরের কোনও নাটকের অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ হল। যাঁরা অভিনয় করলেন, তাঁরা সবাই স্থানীয় গ্রামগুলি থেকে আসা সাঁওতাল ছেলেমেয়ে। যাঁদের পরিবারে কেউ কখনও নাটক–থিয়েটারে অভিনয় করেননি। ৪০ মিনিটের নাটকের গোটাটাই সাঁওতালি ভাষায়। এমনকী, গানগুলিও। সাধারণ দর্শকের কাছে ‘রক্তকরবী’ অনুভবের নাটক। এখানেও ভাষার প্রতিবন্ধকতা প্রবল। কিন্তু, আরাবাহার ছত্রে ছত্রে রক্তকরবীকে অনুভব করা যায়। রতন বললেন, ‘‘নাটক মানেই তো জীবনের কথা। ভাষা সেখানে কখনও বাধা হয় না। যে কোনও মন ছুঁয়ে যাওয়া নাটকই জীবনের কথা, প্রতিবাদের কথা বলে। আদিবাসী উপজাতিগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকিয়ে আছে। যারা কখনও নাটক করেনি, তাদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। এর প্রসার দরকার। তবেই সত্যিকারের স্বপ্ন সফল হবে।’’

বিশু পাগলের গানে নন্দিনীর পুলকিত হওয়া কিংবা নন্দিনীর জন্য কিশোরের ফুল নিয়ে আসা, অধ্যাপকের গুরু-গম্ভীর আচরণ— নাটকের কোথাও-ই সুকুল মুর্মু, সুরিয়া হেমব্রম, জগন্নাথ কিস্কু, সুনীল কিস্কুদের জড়তা নেই। জগন্নাথ ওরফে বিশু কখনও রবি ঠাকুরের গান করেননি। সাঁওতালি ভাষায় সোহরাই বা বাহার সুরে রবি ঠাকুরের গানের কথা বসিয়ে গাইতে গিয়ে অবাক হয়েছেন নিজেই।

খোলা মাঠের চারপাশে নতুন করে শালগাছ লাগানো হয়েছে। অতীতকে ফিরে পেতে জঙ্গলও যে আরও বেশি করে দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন