সার্কাসের নতুন ‘হিরো’ রামু

টিকিট না পেয়ে টিকিট-ঘরটাই ঝাঁকাচ্ছে জনতা! এই বুঝি তুলে নিয়ে যায় যায়! ভিতরে দুই যুবক পরিত্রাহী চিৎকার করে ক্ষিপ্ত জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, ‘‘পরের শো কনফার্ম দাদা।

Advertisement

অনির্বাণ সেন

মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৬ ০০:৫০
Share:

খেলা দেখিয়ে দর্শকের নজর টানছে এই রামছাগল। —নিজস্ব চিত্র

টিকিট না পেয়ে টিকিট-ঘরটাই ঝাঁকাচ্ছে জনতা!

Advertisement

এই বুঝি তুলে নিয়ে যায় যায়! ভিতরে দুই যুবক পরিত্রাহী চিৎকার করে ক্ষিপ্ত জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, ‘‘পরের শো কনফার্ম দাদা। ভিতরে আঙুল গলাবার জায়গা নেই! লক্ষ্মী দাদা!’’ কে কার কথা শোনে— তাঁবুর ভিতর থেকে যত মিউজিক উড়ে আসছে, জনতার সুরও চড়ছে!

বাঘ-সিংহ-জিরাফ নয়, রামুকে দেখতেই ভিড়ে জমজমাট ছিল মহম্মদবাজার থানার পাশের মাঠ।

Advertisement

এই সে দিনও সন্ধে সন্ধে রয়্যাল সার্কাসের তাঁবু ঘিরে রীতিমতো মেলার মেজাজ। তাঁবুর ভিতরে গ্যালারি আর চেয়ার মিলিয়ে প্রায় শ’তিনেক দর্শক। খেলা শুরু হলও বলে! লাল-সবুজ আলোর সঙ্গে সাউন্ড বক্সে বাজছে ‘মেরা নাম জোকার’-এর সেই সুপারহিট গানের মিউজিক, ‘জিনা ইয়াহাঁ, মরনা ইয়াহাঁ, ইসকে সিবা জানা কাহাঁ।’ বাইরে চিনে বাদাম, লম্ফর নিবু নিবু আলোয় আলু কাবলির ফাঁক দিয়ে দুই জোকার ঘোষণা করে যাচ্ছে, ‘শুরু হল বলে। প্রধান আকর্ষণ রামু।’ সেই শুনেই সপরিবারে রয়্যাল সার্কাসের টিকিট কেঠেছে জনতা।

আজ মহম্মদবাজার তো কাল বহরমপুর— সন্ধে রাতের সার্কাসে এভাবেই রাজ্যের গ্রাম-শহর মাতিয়ে বেড়াচ্ছে রামু। কে রামু?

‘রামু’ আর কেউ নয়। একটি ছাগল। সাদার উপর কালো ছোপ দেওয়া এই গৃহপালিত জন্তুটিই খেলা দেখিয়ে মন জয় করে নিয়েছে মহম্মদবাজার, বহরমপুর, বর্ধমানের। তার জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায় তাঁবুর বাইরে টিকিট কাউন্টারের বাইরে ভিড়ের বহর দেখে। আর ভিতরে ঢুকলে চমক যেন কাটতেই চায় না। বাঁশি পড়তেই লাল ও নীল স্পট লাইটে দেখা যায় রিং। তার উপর এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত লাগানো ইঞ্চি দু’য়েক চওড়া পাতের উপর দিয়ে দিব্যি গটগটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে রামু! পাতের উপর লাগানো একটা ছোট কাঠের উপর দাঁড়িয়ে তাতে দু’পাক ঘুরছেও। প্রতিবার খেলা দেখিয়ে উপর থেকে নিচে নামতেই হাততালিতে ফেটে পরে গোটা সার্কাসের তাঁবু।

ছেলে ঋষভকে নিয়ে সার্কাস দেখতে নিয়ে এসেছিলেন রঞ্জিত রুজ। মেয়ে এষার আব্দারে তাকে নিয়ে সার্কাস দেখতে ঢুকেছিলেন প্রণব গাঙ্গুলি। রঞ্জিতবাবু, প্রণববাবুরা জানালেন ‘‘আমরা ছোটতে সার্কাসে বাঘ-সিংহর খেলা দেখার টানেই সার্কাস দেখতে আসতাম। কিন্তু পরে সরকার থেকে তো বাঘ-সিংহর খেলা দেখানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের ছেলেপুলেরা আর সে খেলা দেখতে পেল না। তবে এই ছাগল দিয়েই যে খেলা দেখনো হলো সেটাই বা কম কি?’’

কিন্তু কী ভাবে এটা সম্ভব হল?

রয়্যাল সার্কাসের মালিক তথা ছাগলের রিং মাস্টার জামাল মণ্ডল বলছিলেন সে কথা। ‘‘তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন বাবা মার সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে। সে সময় আমাদের বাড়ি নদিয়ার কৃষ্ণনগরে মেট্রো সার্কাস নামে একটি সার্কাস চলছিল। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ওখানেই সার্কাসের লেবারের কাজে যোগ দিই। এরপর আস্তে আস্তে ওখানেই একটু একটু করে সার্কাসের খেলা শিখতে শুরু করি। কিন্তু হঠাৎ-ই বন্ধ হয়ে গেলো মেট্রো সার্কাস। ওখান থেকে বেরিয়ে দু’জনে মিলে একটা নতুন সার্কাসের দল করলাম। কিছুদিন চলল। তারপরে নিজেই দল খুললাম।’’

সেই দলই রয়্যাল সার্কাস। জামাল বলছিলেন, কেমন করে একটি একটি করে জিনিস কিনে দল তৈরি করেছেন। কেমন করেই বা রামুকে এনেছিলেন বাজার থেকে। ‘‘ও আমাদের সঙ্গেই থাকতে শুরু করল। হঠাৎ একদিন মনে হল একেও তো খেলা শেখানো যেতে পারে। মাথায় আসতেই শুরু করে দিলাম ওকে তালিম দেওয়া। প্রয় ছ’মাসের চেষ্টায় সফল হলাম আমি আর রামু। আর এখন ওই তো আমাদের সুপারস্টার। ওর খেলা দেখতেই তো ভিড় হয় আমাদের সার্কাসে। ওর জন্যই আমাদের দু’বেলা পেটের ভাত হচ্ছে।’’

বড় সার্কাসের মালিকরাও জামালের এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন। অলিম্পিক সার্কাসের মালিক চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সার্কাসই তো জীবজন্তুদের পোষ মানিয়ে খেলা দেখানোর জায়গা। আগেও ছাগল দিয়ে এ ধরনের খেলা দেখানো হয়েছে। পরে বিভিন্ন কারণে এই খেলা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট দলগুলি কম খরচের মধ্যে আবার এই খেলা ফিরিয়ে আনছে। ভালই লাগছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন