নদীর স্রোতে চুরমার চার মাসের কজওয়ে

আশঙ্কাই সত্যি হল। ভরা দ্বারকেশ্বরের জলের তোড় উড়িয়ে দিল দেড় কোটিরও বেশি টাকায় তৈরি কজওয়ে। বাঁকুড়ার সুর্পানগরে দ্বারকেশ্বর নদের উপরে কজওয়ে তৈরি করার সময়েই অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, দ্বারকেশ্বরে বান এলে ওই কজওয়ে টিকবে তো? তা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে যাবে, তা হয়তো অনেকে ভাবতেই পারেননি।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৬ ০১:২৪
Share:

দেড় কোটি টাকায় তৈরি সুর্পানগর-ভাদুলের কজওয়ে ভেঙে পড়ায় উঠেছে দুর্নীতির প্রশ্ন।ছবি: অভিজিৎ সিংহ

আশঙ্কাই সত্যি হল। ভরা দ্বারকেশ্বরের জলের তোড় উড়িয়ে দিল দেড় কোটিরও বেশি টাকায় তৈরি কজওয়ে।

Advertisement

বাঁকুড়ার সুর্পানগরে দ্বারকেশ্বর নদের উপরে কজওয়ে তৈরি করার সময়েই অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, দ্বারকেশ্বরে বান এলে ওই কজওয়ে টিকবে তো? তা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে যাবে, তা হয়তো অনেকে ভাবতেই পারেননি। কিন্তু ওই কজওয়ে চালুর কয়েকমাসের মধ্যেই বিপর্যয় নেমে এল। নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ফুঁসে ওঠা দ্বারকেশ্বর প্রবল বেগে কজওয়ের উপর দিয়ে বইছিল। মঙ্গলবার জল কমতেই বাসিন্দাদের নজরে আসে, ভাদুলের সংলগ্ন এলাকায় কজওয়ের অনেকখানি অংশ একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নদীর উপর ছড়িয়ে রয়েছে। তবে কি পরিকল্পনাতেই ভুল? না কি নির্মাণের পিছনে দুর্নীতি রয়েছে? এই বিপর্যয়ের পরে উঠেছে সেই প্রশ্ন।

যদিও রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘কজওয়ে নষ্ট হয়নি। কজওয়ের সংযোগকারী রাস্তায় বালির উপরে কংক্রিটের যে ব্লক বসানো হয়েছিল, প্রবল জলের তোড়ে তা সরে গিয়েছে। ওগুলো মেরামত করে দেওয়া হবে। এ জন্য কোনও বাড়তি খরচ হবে না।’’

Advertisement

বস্তুত বাঁকুড়া শহর ও ওন্দার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, ভাদুল ও সুর্পানগরের মাঝে একটা স্থায়ী সেতু তৈরি করা হোক। কারণ বছরের অন্য সময়ে শুখা এই নদীর উপর বোল্ডার ও বালির অস্থায়ী রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা গেলে বর্ষায় এই নদী পারাপার করা দায় হয়ে পড়ে। সেই দাবি মেনে নেয় প্রশাসন। কিন্তু সেতুর বদলে কজওয়ে তৈরির কাজ শুরু হয়। জানা গিয়েছে, সেচ দফতরের কংসাবতী বিভাগ প্রায় ১ কোটি ৫৮ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ওই কজওয়ে তৈরিতে হাত দেয়। বড় সেতু না মিললেও কজওয়েতে সমস্যা কিছুটা হলেও মিটবে বলেই আশা করেছিলেন গ্রামবাসী। সেই সঙ্গে অভিজ্ঞেরা ওই কজওয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাও করেছিলেন। তৈরি হওয়ার চারমাসের মধ্যেই নদীর বান ভেঙে দিয়ে গেল সেই কজওয়ে!

এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে দ্বারকেশ্বর নদ সংলগ্ন ওন্দা ব্লকের ভাদুল ও সুর্পানগর এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। পাশাপাশি দ্বারকেশ্বরের মতো বড় নদীতে এই ধরনের কজওয়ে বানানো কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে খোদ জেলা প্রশাসনের অন্দরমহলেও। দ্বারকেশ্বর নদ পারাপারের জন্য ভাদুল ও সুর্পানগরের মধ্যে সংযোগকারী ওই কজওয়ে তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল গত বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে-আগে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই সেই কজওয়ের কাজ শেষ হয়ে যায় ও জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

তবে কজওয়েটি চালু হওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। যা দেখে প্রশ্ন ওঠে এই কজওয়েটি সঠিক পদ্ধতিতে গড়া হয়েছিল কি না তা নিয়েই। বর্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই ওই কজওয়ের রাস্তায় ফাটল ধরা পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই কজওয়েটি তৈরি করার সময় নির্মাণ সামগ্রীর মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। কজওয়ের তলায় নদীর জল বের হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ পাইপও বসানো হয়নি বলেই বাসিন্দারা অভিযোগ তুলেছিলেন।

ভাদুল গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ দাস, সুরজিৎ ঘোষ বলেন, “এই কজওয়ের নীচে নদের জল পার হওয়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় পাইপই তো দেওয়া হয়নি। তাই নদীর জল ভালভাবে বের হতে পারছিল না প্রথম থেকেই। ফলে কজওয়ের উপরে জলের স্রোত ধাক্কা মারছিল। বর্ষার শুরুতেই নদীতে জল বাড়তেই তাই কজওয়ের রাস্তা ভাঙতে শুরু করেছিল। শেষে বড় বান এসে কজওয়েটিকে একেবারে ভেঙে দিয়ে গেল।” ওন্দার সুর্পানগর গ্রামের বাসিন্দা পরমানন্দ ঘোষালের আক্ষেপ, “প্রতি বছর বর্ষায় এই নদে জল বেড়ে গেলে আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের সেতু ধরে বাঁকুড়ায় যেতে হয়। ভেবেছিলাম এ বার সমস্যা মিটবে। কিন্তু তা আর হল কই! সমস্যা যে কে সেই রয়েই গেল।”

কজওয়ের হাল যে রুগ্ন হয়ে পড়ছে তা অবশ্য প্রশাসনেরও নজর এড়ায়নি। মাসখানেক আগেই তা জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু এ নিয়ে সেচ দফতরকে সতর্ক করেছিলেন। কজওয়ের সমস্যা ছবি-সহ লিখিত ভাবে রাজ্য সেচ দফতরেও জানিয়েছিলেন তিনি। জেলার এক আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘তারপরেও সেচ দফতরের টনক নড়েনি। তারই খেসারত দিতে হল এ বার।’’

জেলাশাসক মৌমিতাদেবী এ দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সদ্য ওই কজওয়েটি নির্মাণ করা হল। এত দ্রুত তা ভেঙে পড়ার তো কথা নয়। কেন এমন হল, তা সেচ দফতরের কাছে জানতে চাইব। জেলাপ্রশাসনও সব দিক খতিয়ে দেখছে।”

এই বিপর্যয়ের পরে ওই কজওয়েটি গড়ার পদ্ধতি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তেমনই আবার দ্বারকেশ্বর নদের মতো একটা বড় নদীতে কজওয়ে গড়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিস্তর। জেলা পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, “বড় নদীতে কজওয়ে গড়া সবসময়ই ঝুঁকির। এ ক্ষেত্রে কজওয়ে গড়তে গেলেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ঠিকঠাক যাতে জল বের হয়ে যায়, সে ব্যবস্থা করা দরকার।”

জেলা সেচ দফতরের আধিকারিকদের এ দিন বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। ওন্দার বিধায়ক অরূপ খাঁ অবশ্য এ দিনও দাবি করে গিয়েছেন, “কজওয়েটি ভাঙেনি। কজওয়ের রাস্তাটি ভেঙেছে। জলের তোড়ে তা ভাঙতেই পারে। যদি ভেঙেও যায়, আবার গড়ে দেওয়া হবে।” কিন্তু এ ভাবে দেড় কোটি টাকা জলে ফেলার যৌক্তিকতা কী? প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর বিধানসভা এলাকার বাসিন্দারাই।

নির্মাণে কোনও দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছে বিরোধীরা। ওন্দার বাসিন্দা ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা নেতা মানিক মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘আমরা জানতাম এই নদীতে কজওয়ে টিকবে না। তাহলে আগেই বামফ্রন্ট সরকার ওখানে কজওয়ে গড়তে পারত। ভোটের সময় সস্তা রাজনীতি করতে তৃণমূল সরকার ওই কজওয়ে করেছিল। দুর্নীতিও হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।’’

যদিও সেচমন্ত্রীর দাবি, ‘‘যাঁরা দুর্নীতি ও অপরিকল্পনার অভিযোগ তুলছেন, তাঁরা কিছু না জেনেই শুধু বদনাম করার জন্য ও সব বলছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন