প্রতীকী ছবি।
রাতে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পর থেকে আর এটিএম-এ টাকা তোলার সুযোগ পাননি পেশায় গাড়ি চালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের দিন সকালেই ভাড়া নিয়ে দূরে পাড়ি দেওয়ার কথা দিয়ে রেখেছিলেন বাঁকুড়া সদর থানার আঁচুড়ির ওই বাসিন্দা। কিন্তু গাড়ির ট্যাঙ্কে তেল ভরবেন কী ভাবে? ভেবে আকূল। অগত্যা গোবিন্দনগরের একটি পেট্রোল পাম্পে গিয়ে ধার চেয়ে বসলেন। পাম্প মালিকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপ ছিল না। তবে সেই দিন বাপিবাবুর অনুরোধ মেনে ধারে তাঁকে তেল দিয়েছিলেন। এই ঘটনার এক বছর পরেও বাপিবাবু সেই উপকারের কথা ভুলতে পারেননি। তিনি বলেন, “ওই পরিস্থিতিতে পাম্প মালিকের সাহায্যে যাত্রীর কাছে মুখরক্ষা হয়েছিল।”
হাতে থাকা কিছু পুরনো নোট ব্যাঙ্কে জমা দিতে গিয়ে ভিড় দেখে চোখ কপালে উঠেছিল বাঁকুড়ার ব্যাপারীহাটের প্রবীণ বাসিন্দা দিলীপ নাগের। লম্বা লাইন ঠেলে তাঁর পক্ষে টাকা জমা দেওয়া সম্ভব নয় বুঝে, তিনি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়েই কয়েক জন গ্রাহক এগিয়ে এসে প্রবীণ বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে সবার আগে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। দিলীপবাবুর কথায়, “নিজেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বয়স্ক মানুষ বলে আমাকে আগে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ওঁদের সহানুভূতি আজও ভুলিনি।”
নোট বাতিলে সাধারণ মানুষকে একদিকে যেমন চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছিল, তেমনই এমনই টুকরো টুকরো ‘পাশে দাঁড়ানোর’ ঘটনা মানুষজনের মনে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে রয়ে গিয়েছে। তাঁরা বলছেন, ওই কঠিন সময় দেখিয়ে দিয়েছে, এই যান্ত্রিকতার যুগেও অসময়ে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা এখনও রয়েছে অনেকেরই মধ্যে।
বাঁকুড়ার যোগেশপল্লির বাসিন্দা প্রশান্তকুমার দে-র ক্যাটারিং ব্যবসা রয়েছে। তিনি বলেন, “বিয়ে বাড়ির মরসুমে নোটবন্দি কার্যত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চেক ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে নাম মাত্র টাকা পাওয়া যাবে জেনেও, সেই সময়ে সাধারণ মানুষের মুখ চেয়েই আমরা নগদের বদলে চেকেই টাকা নিয়েছিলাম।’’
প্রতাপবাগানের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী সুনীল মণ্ডল জানান, তাঁর কাছে কিছু খুচরো টাকা ছিলই। তারপরে দু’বার লম্বা লাইন দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বাতিল টাকা বদল করে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর এক সহকর্মী খুচরো টাকা দিতে না পারায় নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না শুনে সুনীলবাবু নিজের সংগ্রহ করা খুচরো টাকা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
বাঁকুড়া শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেবীপ্রসাদ দে বলেন, “মুদিখানা দোকানে কোনও দিন ধার করিনি। তবে ওই সময় মুদি দোকানি মাস খানেক আমাকে ধার দিয়েছিলেন বলে সংসার চালাতে পেরেছিলাম।” বাঁকুড়ার মাচানতলা এলাকার একটি হোটেলের মালিক তরুণ হালদার মনে করান, “নগদের অভাবে হোটেল বন্ধ করে দেওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল। তবে সেই সময় আনাজ বিক্রেতা থেকে মুদি ব্যবসায়ী— সকলেই পাশে দাঁড়িয়ে ধারে মাল দিয়েছিলেন বলেই হোটেল টানতে পেরেছিলাম।”
নোটবন্দির বছর ঘোরার সময় বাপিবাবু, দিলীপবাবু, দেবীপ্রসাদবাবু, তরুণবাবুদের উপলব্ধি— ‘‘ওই সময়টা জানিয়ে দিয়েছে, এখনও ভাল মানুষ রয়েছেন।’’ বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান পারমিতা রায় বলেন, ‘‘জনজীবনে যখন সামগ্রিক সমস্যা নেমে আসে, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। নোটবন্দির সময়েও সেটাই দেখা গিয়েছে।’’