স্বস্তি মিলেছে, কিন্তু নিশ্চিন্ত নন বনবাসীরা

স্থগিতাদেশে কিছুটা স্বস্তি মিললেও পাট্টা ছাড়া বন দফতরের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী, বনবাসী পরিবারগুলি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:০১
Share:

—ফাইল চিত্র।

দিন চারেক আগে নিজেদের নির্দেশেই সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশে কিছুটা স্বস্তি মিললেও পাট্টা ছাড়া বন দফতরের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী, বনবাসী পরিবারগুলি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।

Advertisement

পাট্টা ছাড়া জঙ্গলের জমিতে বসবাস করছেন এমন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ও বনবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হবে— ১৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের এমন নির্দেশের জেরে দেশ জুড়ে আতঙ্কে ভূগতে শুরু করেছিলেন আদিবাসীরা। প্রশাসনিক হিসেবে, ওই নির্দেশ কার্যকর হলে দেশে ভিটেমাটি খোয়াতে হবে প্রায় ১২ লক্ষ আদিবাসী পরিবারকে। এ রাজ্যে সেই সংখ্যাটা ৮৫ হাজারের বেশি।

আদিবাসী সংগঠনগুলির বক্তব্য— নির্দেশে স্থগিতাদেশ মিলেছে, খারিজ করা হয়নি, তাই মাথার উপর ‘খাঁড়া’ এখনও ঝুলতে থাকায় আলাপ আলোচনা ও আন্দোলন সংগঠিত করার পরিকল্পনা থেকে তারা সরে আসতে রাজি নয়। বরং ভবিষ্যতে যাতে নির্দেশ কার্যকর না হয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত যাতে নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করে, সে জন্য পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে সংগঠনগুলি। ব্যতক্রম নয় বীরভূমেও।

Advertisement

জেলার আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেন বলেন— ‘‘নিরক্ষর, প্রান্তিক আদিবাসীরা জঙ্গল ঘেঁষেই বসবাস করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে চূড়ান্ত হতাশা ছড়িয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে প্রান্তিক আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নবাদী শক্তির সঙ্গে জুড়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় একটা পদক্ষেপ হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতেও যাতে আদিবাসী ও বনবাসীদের উপর আঘাত না আসে, নিজেদের মধ্যে একত্রিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। গাঁওতা নেতার কথায়, ‘‘উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তাই একটু থেমে রয়েছি। পরীক্ষা শেষ হলেই ওই মর্মে জেলাশাসককে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।’’

কেন এমন পরিস্থিতি?

বনবাসীদের যে যেখানে বাস করছেন, তিনিই সেই জমির মালিক হিসেবে গণ্য হবেন— ২০০৬ সালে আদিবাসী ও বনবাসীদের জঙ্গলের উপর অধিকার নিশ্চিত করতে মনমোহন সিংহ সরকার ‘অরণ্যের অধিকার’ আইন এনেছিল। সেই বছর থেকে জঙ্গলের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী ও মূলবাসীদের ভূমি ও জমি পাট্টা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু বন্যপ্রাণপ্রেমীদের কয়েকটি সংগঠন ওই আইনের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে।

আদালতের কাছে মামলাকারীদের দাবি ছিল, পাট্টার আবেদন খারিজ হয়েছে, জঙ্গলে বসবাসকারী সে সব পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ করতে হবে। আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কোনও আপত্তি না তোলায়, সুপ্রিম কোর্ট ১৩ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে পশ্চিমবঙ্গ সহ ২১টি রাজ্যকে নির্দেশ দেয়— জঙ্গলে বসবাসকারী যে ১১ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষের জমির অধিকার খারিজ হয়েছে, তাদের সরিয়ে দিতে হবে। পাট্টা ছাড়া বন দফতরের জমিতে বসবাস করছেন তেমন পরিবারগুলির আতঙ্কের শুরু সেখান থেকেই। সমস্যা ছিল বীরভূমেও।

জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ‘অরণ্যের অধিকার আইন’ আসার পরে ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৮৮৩ জন পাট্টার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। পাট্টা পান ৪৯৮ জন। ‘কমিউনিটি পাট্টা’-ক (আইন অনুযায়ী যেখানে একটি গোষ্ঠী পাট্টা পেতে পারে) জন্য আবেদন পড়েছিল ৬৭টি । তা মঞ্জুর হয় ১৩টি ক্ষেত্রে।

কিন্তু আদিবাসী সংগঠনের দাবি ছিল, অর্ধেক সংখ্যক পাট্টার আবেদন খারিজ হয়েছে। অন্য জেলার তুলনায় এ জেলায় বনভূমির (১৬ হাজার ৫৪৪ হেক্টর) তুলনায় জঙ্গলের আয়তন কম হলেও, জঙ্গলে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি দফতর বিশেষত বন দফতরের গাফিলতিতে অধিকাংশ আদিবাসী পরিবার জানতেই পারেননি, কোথায় কী ভাবে আবেদন করবেন। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এখন আবেদন করতে হয় অন-লাইনে। কিন্তু কোনও আবেদন বকেয়া পড়ে নেই।

প্রথম বার আপত্তি না তুললেও সুপ্রিম কোর্ট ওই নির্দেশ দেওয়ার পরেই কেন্দ্রীয় সরকার তা সংশোধনের আর্জি জানিয়ে বলে, ‘সিডিউলড ট্রাইব অ্যান্ড আদার ট্র্যাডিশলান ফরেস্ট ডুয়েলার্স (রেকগনিশন অব ফরেস্ট রাইটস) অ্যাক্ট, ২০০৫’ অনুসারে জমির অধিকারের কথা অনেক ‘চরম দরিদ্র ও নিরক্ষর’ বনবাসী জানেন না। এই নির্দেশ তাঁরা বঞ্চিত ও উচ্ছেদ হবেন। মামলাটি গ্রহণ করে বেঞ্চ। বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি নবীন সিংহের বেঞ্চ রাজ্যগুলিকে হলফনামা দিয়ে জানাতে বলে, বনবাসীদের জমির দাবি নাকচের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে। নির্দেশে বেঞ্চ বলেছে, ‘১৩ ফেব্রুয়ারির নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়া হল।’ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ১০ জুলাই। জানানো হয়েছে, রাজ্যগুলির পক্ষে হলফনামা দিতে হবে মুখ্যসচিবদের।

আদিবাসীদের অপর সংগঠন জাকাত মাঝি পারগাণা মহলের নেতা নিত্যানন্দ হেমব্রম বলছেন, ‘‘স্থগিত হয়েছে বটে কিন্তু খারিজ তো হয়নি। নির্দেশ কার্যকর হলে উচ্ছেদ হওয়া প্রান্তিক পরিবারগুলি কোথায় যাবেন বলতে পারেন? সে জন্য আমরা এখন জনমত তৈরি করছি। মানুষকে সচেতন করছি। বোঝাতে চাইছি, এমন নির্দেশ প্রয়োগ হলে কত পরিবার ভিটে হারাবেন। যাতে আন্দোলন শুরু হলে ভুল বোঝাবুঝি না থাকে।’’ তিনি জানিয়েছেন, এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ জানানো হবে, সর্বোচ্চ আদালত যেন নির্দেশ পুর্নবিবেচনা করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন