শিকড়ের সন্ধান টুসু গানে

‘‘টুসুর ঘরটাই আসলে আমাদের দেশ,’’ বলছিলেন নিতুড়িয়ার একটি স্কুলের শিক্ষিকা জয়তী দেওঘরিয়া, আদ্রার বেকো হাইস্কুলের শিক্ষিকা রোমি চৌধুরীরা।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:০৮
Share:

মানুষের শিকড় বলে একটা কথা বেশ প্রচলিত। ব্যাপারটা কী রকমের?

Advertisement

ওঁরা জেলার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষিকা। রোজ পুরুলিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে চলে যান দূর দূরান্তের কর্মস্থলে। সন্ধ্যায় ফিরে আসেন ঘরে। এমন ভাবে বছর যায়। একটা সময়ে টুসু আসে লাল মাটির দেশে, সময়ের স্টেশন পার হতে হতে। মানভূম, পুরুলিয়া—নামগুলো পাল্টে যায়। টুসুর ঠিকানা বদলায় না।

‘‘টুসুর ঘরটাই আসলে আমাদের দেশ,’’ বলছিলেন নিতুড়িয়ার একটি স্কুলের শিক্ষিকা জয়তী দেওঘরিয়া, আদ্রার বেকো হাইস্কুলের শিক্ষিকা রোমি চৌধুরীরা। রবিবার কংসাবতীর চরে চৌডল নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। ট্রেনের নিত্যযাত্রা থেকে আলাপ তাঁদের দশ-বারো জনের। সেই থেকে বন্ধুত্ব। নিজেদের বলেন, ‘পথের সাথী’। ছেলেবেলার টুসু নিয়ে উন্মাদনা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে বলে গত বছর আক্ষেপ করেছিলেন তাঁরা।

Advertisement

এ বছর এগিয়ে এসেছেন নিজেরাই। শনিবার চৌডল কিনে এনে রাতভর সাজিয়েছেন। রবিবার নিয়ে এসেছেন কংসাবতীর তীরের মেলায়। গান গেয়েছেন নিজেরাই। সাঁতুড়ির মুরাডি গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা প্রতিভা চার বলেন, ‘‘আমি নিজেও এই জেলারই মেয়ে। টুসুর সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। মনে হচ্ছিল, নতুন প্রজন্মের কাছে এই উৎসব আকর্ষণ হারাচ্ছে। তাই ছেলেকেও নিয়ে এসেছি।’’ প্রতিভাদেবীর স্বামী উজ্জ্বলকুমার চারও বলছেন, ‘‘নিজেদের সংস্কৃতিকে নিজেরা রক্ষা না করলে কে করবে?’’

জেলার এক গবেষকের মতে, সংস্কৃতি ইতিহাসকে ধারণ করে রাখে। ইতিহাস বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি, তারও একটা ইতিহাস হয়। যেমন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওলটপালট হয়ে যায় সব। ঘটন-অঘটন যাই হোক, তার পিছনে খুব ধীরে কাজ করে যায় দেশের নদ-নদী, গাছপালা, বাতাস, মাটি। ইতিহাসের সেই যে ইতিহাস, সংস্কৃতি তারই গল্প বলে। কৃষি সভ্যতা থেকে টুসুকে বছর বছর নিয়ে আসে নদীমাতৃক দেশে।

শিক্ষিকা সুপ্রিয়া বাগ, সুজাতা মণ্ডল, মৌমিতা চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘তামাম পুরুলিয়া বঙ্গভুক্তির জন্য হাতিয়ার করে নিয়েছিল টুসু গানকেই। গেয়েছিল, ‘শুন বিহারী ভাই, তরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাঁই’। ভাষা আর সংস্কৃতির সঙ্গে মাটির যোগটা যে কোথায়, টুসু ছাড়া আর কী দিয়েই বা সেই সময়ে বোঝানো যেত?’’

এ দিনের মেলায় একটুকরো ছেলেবেলা ফিরে পেলেন তাঁরা। অতিদূর অতীতে এই নদীর তীরেই হয়তো টুসু ভাসিয়ে গিয়েছিলেন নাম না জানা কোনও পূর্বসূরী। উত্তর প্রজন্মকে নিয়ে মকর সংক্রান্তিতে তাঁরা সেখান দিয়ে হেঁটে গেলেন।

কংসাবতীর তীরে এ বার টুসুগান আর চৌডলের প্রতিযোগিতা হয়েছে। ভিড়ও হয়েছিল প্রচুর। তবে জেলা কুড়মি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুনীল মাহাতো বলছেন, ‘‘মেয়েরা ভোরে গান গাইতে গাইতে চৌডল হাতে নদীর দিকে চলেছে, ছেলেরা গানে গানেই পাল্টা উত্তর দিচ্ছে— সেই টুসু পরব তো এখন ইতিহাসের পাতায়। ভিড় হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা হুজুগে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কাছে পৌঁছনোর জন্য ফের কাজ শুরু করতে হবে।’’

অনেকে বলছেন, সেই কাজটাই এ বছর কাঁসাইয়ের চরে নিজেদের মতো করে শুরু করে দিলেন জেলার ওই শিক্ষিকারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন