বাঁশ-পেটা করার নালিশ, আশ্রম ছাড়ল কিশোরী

আশ্রয় দেওয়ার নামে শিশুশ্রমিকে পরিণত করা হয়েছিল চোদ্দো বছরের এক কিশোরীকে। সেই কাজে পান থেকে চুন খসলেই জুটত বেদম মার। এমনকী, মেয়েটির মুখে বালিশ চাপা দিয়ে বাঁশ দিয়ে পেটানোও হয়েছে বলে অভিযোগ। আতঙ্কিত মেয়েটি আশ্রম থেকে পালিয়ে এক বাসিন্দার বাড়িতে গিয়ে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচায়। এরই পাশাপাশি কণ্ঠি বদল করে ওই নাবালিকার ‘বিয়ে’ দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছে পরিবার।

Advertisement

সমীর দত্ত

বরাবাজার শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০২:০৯
Share:

নির্যাতনের অভিযোগ শুনছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা। —নিজস্ব চিত্র।

আশ্রয় দেওয়ার নামে শিশুশ্রমিকে পরিণত করা হয়েছিল চোদ্দো বছরের এক কিশোরীকে। সেই কাজে পান থেকে চুন খসলেই জুটত বেদম মার। এমনকী, মেয়েটির মুখে বালিশ চাপা দিয়ে বাঁশ দিয়ে পেটানোও হয়েছে বলে অভিযোগ। আতঙ্কিত মেয়েটি আশ্রম থেকে পালিয়ে এক বাসিন্দার বাড়িতে গিয়ে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচায়। এরই পাশাপাশি কণ্ঠি বদল করে ওই নাবালিকার ‘বিয়ে’ দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছে পরিবার।

Advertisement

ঘটনাটি বরাবাজার থানার মুরাডি গ্রামের একটি আশ্রমের। বৃহস্পতিবারই ওই আশ্রমের সাধু জগন্নাথ দাসের নামে থানায় এফআইআর করেছে মেয়েটির পরিবার। এমন মারাত্মক অভিযোগ হওয়ার পরেও পুলিশ ওই সাধুকে গ্রেফতার না করায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এলাকায়। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার-র বক্তব্য, ‘‘ওই ঘটনায় মেয়েটির পরিবার একটি অভিযোগ দায়ের করেছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।’’ কী কী ধারায় মামলা রুজু হয়েছে, তা তিনি বলতে পারেননি। এ দিকে, ঘটনার খবর পৌঁছেছে জেলা চাইল্ড লাইনের কাছেও। চাইল্ড লাইনের জেলা কো-অর্ডিনেটার দীপঙ্কর সরকারের বক্তব্য, ‘‘দু’টিই গুরুতর অপরাধ। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত পুলিশের।’’ শীঘ্রই গ্রামে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন চাইল্ড লাইনের কর্তারা।

বরাবাজার থানা এলাকার একটি গ্রামের বাসিন্দা ওই মেয়েটির বাবা সাত বছর আগে মারা গিয়েছেন। কঠিন রোগে শয্যাশায়ী মায়ের সঙ্গে সে গ্রামেই বাস করত। কিন্তু, কয়েক মাস থেকে মেয়েটির মা অসুখের কারণে কোনও কাজ করতে পারছিলেন না। সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল। মেয়েটির মায়ের কথায়, ‘‘ওষুধ তো দূরের কথা দু’জনের পেট চালানোই দায় হয়ে উঠেছিল। বরাবাজারের পুইজাঙ্গা গ্রামের আশ্রমের সাধু শিবানন্দ দাসের আমাদের গ্রামে যাতায়াত আছে। আমরাও ওঁর ভক্ত। এক দিন বাড়িতে এলে ওঁকে আমাদের কষ্টের কথা জানাই। উনিই মুরাডি গ্রামের আশ্রমে জগন্নাথ দাস নামে ওঁর এক ভাইপোর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে তিনিই আমাদের মা-মেয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।’’ মাসখানেক পরে শরীর আরও ভেঙে পড়ায় জগন্নাথ সাধু মহিলাকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসেন। সেই থেকে তাঁর মেয়ে একাই ওই আশ্রমে ছিল।

Advertisement

আশ্রম থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে সোমবার রাত ১২টা নাগাদ পুলিশই মেয়েটিকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এ দিন চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে মেয়েটি জানায়, ‘‘আশ্রমে আমাকেই রান্নার দায়িত্ব সামলাতে হতো। তরকারিতে তেল বা নুন একটু বেশি হয়ে গেলেই চ্যালাকাঠ দিয়ে সাধু আমাকে পেটাতেন। ওঁর কাপড় কাচার সময় সাবান একটু বেশি খরচ হলেই মা-বাবা তুলে গালাগাল দিতেন। গালে কষে চড় বসিয়ে দিতেন। এ মাসের গোড়ার দিকে সাধু মাথা ন্যাড়া করে আমাকে মালা চন্দন পরিয়ে কণ্ঠি বদল করেন। আমাকে ওঁর দাসী করেন। আশ্রমে থাকতে হলে নাকি এই সব নিয়ম মানতে হবে!’’

মেয়েটি জানায়, মায়ের কথা ভেবে সে সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু সোমবার দুপুরের পরে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। মেয়েটি বলে, ‘‘কাপড় কাচার জন্য জল আনতে গিয়ে রান্নায় একটু দেরি হয়েছিল। সেই অপরাধে সাধু মেঝেতে ফেলে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে আমাকে বাঁশ পেটা করল!’’ আতঙ্কিত মেয়ে সে দিনই আশ্রম থেকে পালিয়ে পাশের গ্রামে ছেড়ে এক বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাঁরাই পুলিশে খবর দেন। ‘‘পুলিশকে মারের দাগ দেখিয়েছি। ওরা ছবিও তুলে রেখেছে। আমি লোকটার উপযুক্ত শাস্তি চাই।’’

বরাবাজার থানা এলাকায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে, যারা মেয়েদের মধ্যে সচেতনতার প্রসারে কাজ করে। সংস্থার অন্যতম নেত্রী চিন্তামণি কুমার, সন্ধ্যা ষড়ঙ্গী এ দিন বলেন, ‘‘নাবালিকার উপর নির্যাতনের খবর জেনে আমরা বুধবার ওদের বাড়িতে যাই। বিস্তারিত জানার পরে মেয়েটিকে সঙ্গে থানায় অভিযোগ জানিয়েছি।’’ যদিও মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জগন্নাথ দাস। তিনি বলেন, ‘‘ভুল করলে ছোটদের একটু আধটু বকতে হয়। নইলে শিক্ষা হয় না।’’ আর কণ্ঠি বদল? অভিযুক্ত সাধুর যুক্তি, ‘‘মালা চন্দন পরিয়ে কণ্ঠি বদল করাটা আখড়ার অঙ্গ।’’

মেয়েটির মা অবশ্য সাধুর কড়া শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘গ্রামে যে ভাবে হোক চালিয়ে নেব, কিন্তু মেয়েকে আর ওই আশ্রমে পাঠাব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন