অস্বস্তি ১: একশোর গেরোয় তৃণমূল

তদন্তের দাবি উঠল দলের অন্দরেও

এত দিন দাবি তুলছিলেন বিরোধীরা। এ বার একই সুরে ষাটপলশা-কাণ্ডে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত বলে জানিয়ে দিলেন ময়ূরেশ্বর ১ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০৬:৩৬
Share:

ষাটপলশার প্রধানকে ঘিরে বিক্ষোভ। শনিবারের নিজস্ব চিত্র

এত দিন দাবি তুলছিলেন বিরোধীরা। এ বার একই সুরে ষাটপলশা-কাণ্ডে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত বলে জানিয়ে দিলেন ময়ূরেশ্বর ১ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

Advertisement

ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশা পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এলাকার তৃণমূল নেতা তথা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলের বিরুদ্ধে। ওই পঞ্চায়েতে বছরের পর বছর মজুরদের জবকার্ড ও পাসবই আটকে রেখে যন্ত্র দিয়ে কাজ করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই এলাকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। টাকা ফেরতের দাবিতে পঞ্চায়েতের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সুপারভাইজারদের আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন জবকার্ডধারীরা। বিপাকে পড়ে শুক্রবার সকালেই দলীয় কার্যালয়ে ডেকে স্থানীয় গুনুর গ্রামের জবকার্ডধারীদের হাতে আত্মসাতের আড়াই লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জটিলের বিরুদ্ধে। তিনি অবশ্য অভিযোগই মানতে চাননি।

যদিও গোটা ঘটনায় তদন্তের দাবি তুলেছেন ধীরেন্দ্রমোহনবাবু। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য, ‘‘মজুরদের কাজ যন্ত্র দিয়েই করানো হয়ে থাকলে সেই টাকা তো সরকারের। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসনেরই ওই টাকা ফেরানো উচিত। বিশেষ করে বিডিও, যিনি ওই প্রকল্পের ব্লক নোডাল অফিসার, তিনিও এর দায় এড়াতে পারেন না। তা ছাড়া পঞ্চায়েত স্তরে নিয়মিত কাজ দেখভালের জন্য নির্মাণ সহায়ক রয়েছেন। যন্ত্রে কাজ হলে তাঁরই সর্বাগ্রে রিপোর্ট করার কথা। জেলা প্রশাসনের বৈঠকে আমি এ ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানাব।’’ আর এই প্রেক্ষিতেই ষাটপলশা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে শাসকদলের অন্দরে। প্রকাশ্যে না বললেও জেলা সভাপতি অনু্ব্রত মণ্ডলের খাসলোক বলে পরিচিত জটিলের ভূমিকায় দলের একাংশ রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, গোটা ঘটনায় দলেরই সম্মানহানি হচ্ছে। এলাকার এক নিচুতলার কর্মীর মতে, ‘‘বিধানসভায় মানুষ আমাদের ঢেলে ভোট দিয়েছেন। যেটুকু সমস্যা রয়েছে, কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করে কাউবে বা পদ থেকে সরিয়ে আত্মশুদ্ধির কাজও শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে ষাটপলশা নিয়ে নেতৃত্ব কোনও কড়া অবস্থান না নিলে দলের ভাবমূর্তিই নষ্ট হবে।’’

Advertisement

এ দিকে, গুনুর গ্রামে টাকা ফেরানোর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শনিবার ফের স্থানীয় চন্দ্রপলশা গ্রামে টাকা ফেরতের দাবিতে সুপারভাইজারদের দীর্ঘ ক্ষণ আটকে রাখেন গ্রামবাসীরা। শেষমেশ মুচলেকা দিয়ে রেহাই পান সুপারভাইজাররা। আবার বিকেলে ষাটপলশার তৃণমূল প্রধান নন্দদুলাল দাসের সেরুনিয়া গ্রামের বাড়িতেও চড়াও হন বেশ কিছু গ্রামের জবকার্ডধারীরা। কার্যত মারমুখী হয়ে ওঠেন তাঁরা। সাত দিনের মধ্যেই টাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেহাই পান প্রধান। পরে নন্দবাবু বলেন, ‘‘দুর্নীতি হয়ে থাকলে তা সুপারভাইজাররাই জানেন। তাঁদেরই টাকা ফেরত দিতে হবে। তাঁরা টাকা না দিলে প্রশাসনকে বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

প্রধানের আশ্বাসে সাময়িক ভাবে শান্ত হলেও ক্ষোভ যাচ্ছে না এলাকার জবকার্ডধারীদের। স্থানীয় বাসিন্দা রামপদ ভল্লা, অধীর দাসদের অভিযোগ, ‘‘আমাদের সংসদে তিনশোরও বেশি কার্ড রয়েছে। প্রতিটি কার্ড থেকে গত দু’বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা করে আত্মসাত করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা গিয়ে পৌঁছেছে ১ কোটি ২ লক্ষে। জবকার্ড ও পাশবই কাছে না থাকায় এতদিন আমরা সে খবর জানতেও পারিনি। যখন কাজ করতাম ওরা মর্জিমাফিক টাকা দিয়ে যেত।’’ যদিও তাঁরা কোনও টাকা আত্মসাত করেননি বলেই দাবি সুপারভাইজার সমীরণ মণ্ডল, অমর বাগদিদের। তাঁরা এ দিন বলেন, ‘‘জবকার্ড এবং পাশবই বাপ্পার কাছে জমা থাকত। আমরা কাজের পরে মাস্টাররোল করে পঞ্চায়েতে জমা দিতাম। বাপ্পাই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে দিত। আমরা সেই টাকা মজুরদের পৌঁছে দিতাম। টাকা আত্মসাত হয়ে থাকলে বাপ্পার মারফতই হয়েছে।’’

কে এই বাপ্পা?

ঘটনা হল, এর আগেও যেখানেই এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে, প্রতিটি জায়গাতেই উঠে এসেছে বাপ্পার নাম। স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর তিরিশের বাপ্পা ওরফে বাপ্পাদিত্যর আসল নাম সুরথ মণ্ডল। জটিলের পাশের গ্রাম মনোহরপুরে তাঁর বাড়ি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বাপ্পার কম্পিউটারে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। বছর তিনেক আগেও তৃণমূলের অন্দরে বাপ্পার নাম শোনা যেত না বললেই চলে। ১০০ দিনের কাজের সুপারভাইজারির মাধ্যমে শাসকদলের সংস্পর্শে আসেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তার পরেই মজুরের কাজ যন্ত্র দিয়ে করানোর ‘কৌশল’ কাজে লাগিয়ে জটিলের নেকনজরে পড়েন তিনি। তাই দলের কোন পদে না থেকেও অল্প দিনেই বহু পদাধিকারীর মাথায় বসে পড়েন বাপ্পা। পঞ্চায়েত, স্থানীয় ব্যাঙ্ক তো বটেই ব্লকেরও অধিকাংশ দফতরেই তাঁর নাকি অবাধ যাতায়াত। সম্প্রতি ব্লক কৃষি দফতরের একটি কমিটির মাথায়ও এই বাপ্পাকেই বসানো হয়েছিল বলে খবর।

বাসিন্দাদের দাবি, নিজের বাড়ির দোতলায় ১০-১২টি কম্পিউটার বসিয়ে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছিলেন বাপ্পা। দরজার বাইরে লাগানো হয়েছিল নেমপ্লেট। বাইরে নোটিস বোর্ডে লেখা থাকত পঞ্চায়েতের কোন এলাকার লোক কোন দিন কথা বলতে পারবেন। কাজের সূত্রে দোতলার ওই অফিস ঘরে যারা-যাওয়া আসা করেছেন এমন এক জনের দাবি, ‘‘ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে টেবিলের থরে থরে সাজানো থাকত। সেই টাকা ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যেতেন সুপারভাইজাররা। এমনও ঘটেছে, যখন টাকা নেই, স্ট্যাম্প মারা স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে জবকার্ডধারীদের। সেই স্লিপেই স্থানীয় বাজারে সমস্ত রকম জিনিস এমনকী নগদ টাকাও মিলেছে।’’ তাঁর দাবি, কাজ না করেও আগাম হিসাবে টাকা মিলেছে। পরে তা কেটেও নেওয়া হয়েছে। মন্দির, মসজিদ সংস্কার তো বটেই চিকিৎসা এমনকী সরস্বতী পুজোর কার্ড দিতে গিয়েও ৫০০-১০০০ টাকা নিয়ে ফেরার অভিজ্ঞতাও রয়েছে অনেকের। সেই কারণেই এত দিন এলাকায় কোনও ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। আর সেই সুযোগেই বাপ্পার ওই অফিস পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের সরকার টাকা নয়ছয়ের আখড়া হয়ে উঠেছিল বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।

এ দিন অভিযুক্ত বাপ্পার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সংবাদমাধ্যমে ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই রাতারাতি সেই অফিসের পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বাপ্পাও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘আসলে সুপারভাইজাররাই নিজেরা বাঁচার জন্য মিথ্যা করে আমার নাম জড়াচ্ছে। আমার বাড়িতে কোনও অফিস ছিল না। কোনও রকম আত্মসাতের সঙ্গেও আমি জড়িত নই।’’

জটিল এবং তাঁর লোক জনের বিরুদ্ধে যন্ত্র দিয়ে একশো দিনের কাজ করানোর অভিযোগ নতুন। দু’বছর আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসেই এ নিয়ে সরব হয়েছিল আনন্দবাজার। তখন বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন খোদ বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান। তার পরেও ব্লক প্রশাসনের পক্ষে থেকে যে তেমন কিছুই করা হয়নি, তার প্রমাণ মিলছে পরপর অভিযোগ ওঠায়। যদিও বিডিও এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘যে সময় কাজ হয়েছিল, সে সময়ে কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। এখন এই অভিযোগ ওঠার পরে ব্লক প্রশাসন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই তদন্ত কমিটি রিপোর্টে দুর্নীতির কথা উঠে এলে সেই সময়ে ওই কাজে যুক্ত নির্মাণ সহায়ক এবং আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ ব্লক প্রশাসনের একটি দল দু’এক দিনের মধ্যেই এলাকায় গিয়ে সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বলেও বিডিও জানান।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে দেখে আসরে নামতে হয়েছে অনুব্রতকেও। তিনি বলেন, ‘‘সব কিছু খতিয়ে দেখতে কালই ষাটপলশায় যাচ্ছি। গোটা ঘটনায় দলগত তদন্ত হবে। তদন্তে দলের কারও বিরুদ্ধে দুনীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলগত সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন