দুর্লভ দৃশ্য। শনিবারের সেই ব্যস্ততার ছবিটাই গায়েব মন্দিরে।
দেবালয় কি এড়ায়
রামপুরহাট থেকে তারাপীঠ মন্দিরে পৌঁছনো যায় অটো, ট্রেকারে। সকাল দশটায় জাতীয় সড়কের উপরে বগটুই মোড়ে পৌঁছে দেখা গেল তিন জন অটো চালক তারাপীঠ যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে। বছরের অন্য সময়ে এখানে আরও অনেক বেশি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। অটো চালকেরা জানালেন, আধঘণ্টা অন্তর মন্দিরে যাওয়ার লোক মিলছে! কিছু সময় দাঁড়ানোর পরে দেখা গেল সত্যিই তাই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে এক জন যাত্রীকে নিয়েই অটো ছুটল তারাপীঠের দিকে। গাড়ি চালকদের প্রত্যেকেই জানালেন, নোট-বদল নিয়ে হয়রানিতে গত পাঁচ দিনে তারাপীঠে যাত্রী সংখ্যা কমে গিয়েছে। এঁদের এক জনের আবার টিপ্পনি, ‘‘কথায় আছে, নগর পুড়লে দেবালয় কী আর এড়ায়! সকলেই তো এখন ব্যাঙ্ক কিংবা এটিএম মুখী। এখানে আসবে কে?’’
ফাঁকা হোটেল
অন্য সময়ে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা থাকে তারাপীঠের হোটেল-লজগুলিতে। আর এখন? প্রশ্নটা করলাম এখানকার একটি বড় লজের ম্যানেজারকে। বেজার মুখে ম্যানেজার মিতান সেন জানালেন, লজে ৮০টা ঘর আছে। অন্য সময় খুব কম করে হলেও ২০-২২টা ঘর ভাড়া থাকে। ‘‘এখন তো গড়ে দশটা ঘরও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না’’— বলছেন তিনি।
সুনসান রাস্তা।
একটি হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে দেখা মিলল শিলিগুড়ি থেকে আসা সাত পর্যটকের। শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় নামে এক পর্যটক জানালেন, মন্দিরে আসার জন্যে কিছু দিন ধরেই পঞ্চাশ টাকা, একশো টাকা জমাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই সামান্য টাকা নিয়ে চলে এসেছেন তারাপীঠে। বললেন, ‘‘গাড়ি ভাড়ার টাকা অবশ্য বাকি রেখেছি।’’ সুনীল গিরি এক ম্যানেজার জানালেন, গত নয় দিনে ব্যবসায় অন্তত চল্লিশ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।
খাঁ খাঁ রাস্তা
মন্দির সংলগ্ন রামপুরহাট-সাঁইথিয়া রাস্তায় দুপুর বারোটায় অন্য দিন যানজটে পা ফেলাই দায় হয়। একটু বেসামাল হলেই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়। এ দিন দেখা গেল সেই রাস্তাতেও ট্রাফিক পুলিশ নেই, সিভিক ভলান্টিয়ার নেই। ফাঁকা রাস্তা ধরে তারাপীঠ মন্দির যাওয়ার রাস্তায় দেখা মিলল তারাপীঠ লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক তথা তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদের অন্যতম সদস্য দেবীপ্রসাদ মণ্ডলের। তিনি জানালেন, তারাপীঠে ছোট-বড় মিলে ৩৯০টি লজ আছে। গত চার দিনে ছোট লজগুলিতে পর্যটক প্রায় আসেনি বললেই চলে।
ঝোঁক অনলাইনে
তারাপীঠের ৩৯০টি হোটেলের মধ্যে মাত্র চারটি হোটেল-লজে অনলাইনে ভাড়া দেওয়া যায়। পর্যটকদের চাহিদার তালিকায় উপরের দিকে সেগুলিই। দুপুর সাড়ে বারোটার সময়ে মন্দির যাওয়ার রাস্তায় একটি লজ ও খাবারের দোকানে দেখা গেল দর্শনার্থীদের ডেবিট কার্ডে খাবারের মিল মেটাতে। ওই দোকানের মালিক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই বাজারে যেটুকু ব্যবসা চলছে, সেটা ওই প্লাস্টিক কার্ডের দৌলতেই।’’
হোটেলের বিজ্ঞপ্তি।
তবুও বোঝাপড়া
নতুন টাকা কিংবা কার্ড নেই, এমন অনেকেই এই রাস্তায় হাঁটছেন। একটি লজে কথা হচ্ছিল বারুইপুর থেকে আসা পাঁচ পর্যটকের সঙ্গে। আকাশ কর্মকার নামে এঁদের এক জন জানালেন, গোটা কতক পাঁচশো, হাজার টাকা নিয়েই এসেছেন। দিব্য চালাচ্ছেনও। কেমন করে সেটা তিনি ভেঙে না বললেও খোলসা করলেন লজের ম্যানেজার সুনীল গিরি। তাঁর কথায়, ‘‘নতুন টাকা নেই বলে তো আর চেনা কাস্টমার ফেরানো যায় না। পরিচিতদের থেকে পাঁচশো, হাজার টাকা অনেক সময় নিতেই হচ্ছে।”
ফাঁক তালে
দুপুর একটায় মন্দিরের পথে এক জায়গায় জটলা শোনা গেল। কথা বলে জানা গেল, দমদম থেকে আসা পাঁচ পর্যটক আটশো টাকার প্যাড়া কিনেছেন। হাজার টাকা দিয়েছেন দোকানিকে। কিন্তু দোকানি তা নেবেন না। চাইছেন খুচরো। এ নিয়ে তুমুল তর্ক। এক সময় দোকানি একটু মচকাতেই ক্রেতারা একটি পাঁচশো টাকার আর তিনটে একশো টাকার নোট দোকানির গুঁজে তড়িঘড়ি অটোয় উঠে গেলেন। ফাঁক তালে মিলছে কম ভাড়ায় হোটেল-লজও। মালিকপক্ষ বলছেন, ‘‘একেবারেই লোক হচ্ছে না। যাঁরা চলে আসছেন, তাঁদের আর ফেরাচ্ছি না!’’
ঠনঠনে বাক্স
সেবাইত সমিতির প্রণামী বাক্সের দিকে নজর রাখা গেল। কাঁচ দেওয়া বাক্সে বাইরে থেকে দেখা গেল একটিও পাঁচশো, হাজার টাকা নেই। পড়ে আছে সামান্য কিছু নোট!
ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।