দুই পড়ুয়ার স্বপ্নের পাশে আদিবাসী ক্লাব

Advertisement

সমীর দত্ত

বোরো শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:২১
Share:

রঘুনাথ মুর্মু ও স্বপন শবর। নিজস্ব চিত্র।

ফুলের তোড়া, মিষ্টির প্যাকেট, দু’-একটা পড়ার বই আর বড়জোর পাতলা খামে ক’টা টাকা।

Advertisement

প্রতি বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে কৃতী পড়ুয়াদের সংবর্ধনা দেওয়ার হিড়িক দেখা যায়। ঘটা করে অনুষ্ঠান হয়। নেতা-মন্ত্রীরা আসেন। সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায় আলো ঝলসে ওঠে। কিন্তু তার পরে উজ্জ্বল মুখগুলি একটু একটু করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। প্রতি বছর অনেক কৃতি প়ড়ুয়াই অভাবের তাড়নায় পছন্দ মতো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।

তাই এ বারে কৃতী সংবর্ধনার আয়োজন কাটছাঁট করে দুই পড়ুয়ার উচ্চশিক্ষার খরচ বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানাম দিশম উতনৌও গাওঁতা। পুরুলিয়ার বোরো থানার জামতোড়িয়া গ্রামের ওই ক্লাবটির নামের বাংলা করলে দাঁড়ায়— জন্মভূমি উন্নয়ন মঞ্চ। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ক্লাবের পক্ষ থেকে স্বপন শবর এবং রঘুনাথ মুর্মু নামে দুই পড়ুয়ার হাতে এককালীন সাড়ে ছ’ হাজার টাকা করে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ওই দু’জনের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে পড়ার খরচ বাবদ যথাসাধ্য সাহায্য জমা করা হবে।

Advertisement

বোরো থানার মুকুন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা রঘুনাথ মুর্মু। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে সফল হয়ে রঘুনাথ ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ভর্তি হয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। বাবা-মা দু’জনেই দিনমজুরি করে সংসারের খরচ চালান। বরাবরের কৃতি ছাত্র রঘুনাথ মাধ্যমিকে ৮৮ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষার শিখর ছোঁয়ার পথ অভাবের কাঁটায় কঠিন।

স্বপন শবর রত্যাকোচা গ্রামের শবরপাড়ার বাসিন্দা। বড়গড়িয়া হাইস্কুল থেকে ৭৭ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে স্বপন ভর্তি হয়েছেন বাঁকুড়ার খাতড়া কলেজে। বাংলায় অনার্স। স্বপনের বাবা নেই। মা দিনমজুরি করে সংসারের খরচ চালান কোনও মতে। এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আপাতত খড়ের চালার এক কামরার ঘুপচি ঘরে মা-ছেলে থাকেন। সেখানেই গাদাগাদি করে থাকে পোষ্য ক’টি ছাগলও। সমস্ত অনটনকে হারিয়ে স্বপন পেরিয়েছেন কলেজের চৌকাঠ। পরিবারের মধ্যে প্রথম। কিন্তু বাড়তি খরচ তার সামনে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অবস্থায় দুই ছাত্রের কাঁধে হাত রেখেছে জানাম দিশম উতনৌও গাওঁতা। সভাপতি, পেশায় হাইস্কুলের শিক্ষক সুব্রত বাস্কে জানান, ক্লাবের সদস্যদের অধিকাংশই ছোট চাষি। কেউ ছোট ব্যবসা করেন। দু’এক জন রয়েছেন প্রাথমিক বা হাইস্কুলের শিক্ষক। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘সদস্যদের মধ্যে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা প্রতি মাসে কিছু টাকা ক্লাবের ফান্ডে জমা দেন। এছাড়া আমাদের এলাকার কয়েকজন উচ্চপদে চাকরি করেন । আমরা সাহায্যের জন্য তাঁদেরও অনুরোধ করব। পরিবার যতটা পারবে, বাকিটা আমরা নিয়মিত যোগান দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’’

জামতোড়িয়া গ্রামে মূলত আদিবাসী মানুষজনের বসবাস। ক্লাবের তরফে জানানো হয়েছে, ২০০৩ সাল থেকে সামাজিক সচেতনা বাড়াতে বিভিন্ন আলোচনাসভা, বিনামূল্যের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির, বস্ত্র বিতরণ, পড়ুয়াদের বই দেওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা— এমন অনেক কিছুর আয়োজন করে আসছেন।

ক্লাবের কর্মকর্তা লক্ষ্মীনারায়ণ হাঁসদা, পরমেশ্বর সোরেন, নির্মল সোরেনরা বলেন, ‘‘সমস্ত কিছুর পরেও খালি মনে হতো, কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে।’’ তাঁরা জানান, প্রতিবছর যে সমস্ত পড়ুয়াদের সংবর্ধনা দেওয়া হত ক্লাবের পক্ষ থেকে, তাদের অনেকেই পরে অভাবের তাড়নায় পড়া ছেড়ে দিয়েছে বলে খবর পেতেন। তাই এ বারের কৃতী সংবর্ধনার অনুষ্ঠানের বাজেট অনেকটাই কমিয়ে আনেন তাঁরা। থানা এলাকায় খোঁজ খবর করে স্বপন এবং রঘুনাথকে বেছে নেওয়া হয় বছরভর সাহায্যের জন্য।

ক্লাব সদস্য রাজেন্দ্রপ্রসাদ সোরেনের দাবি, বোরো থানা এলাকা থেকে এর আগে কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কুর ছেলে ধুরমল কিস্কু ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। তার পরে রঘুনাথ দ্বিতীয় পড়ুয়া, যে ওই এলাকা থেকে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল। সেই রঘুনাথের বাবা বিপুল মুর্মু বলেন, ‘‘আমরা খুবই গরীব। ছেলেটাকে পড়াতে পারতাম না যদি না ক্লাবের লোকজন পাশে এসে দাঁড়াতো।’’

ক্লাব কর্তারা জানান, স্বপনের লেখাপড়ায় বরাবর সাহায্য করে এসেছেন সম্প্রতি অবসর নেওয়া বড়গড়িয়া হাইস্কুলের করণিক অজিত মাহাতো। স্কুলে পড়ার সময় তিনি বইপত্র দিতেন স্বপনকে। তাঁর অনুরোধে কয়েকজন শিক্ষকও ক্লাসের বাইরে স্বপনকে পড়া বুঝিয়ে দিয়েছেন। স্বপন বলেন, ‘‘কলেজে পড়ার খরচ কী ভাবে আসবে বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাবের দা দারা পাশে এসে না দাঁড়ালে হয়তো পড়াই হতো না আর।’’

ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চায় স্বপন। তত দিন তাঁদের দু’জনেরই স্বপ্নের পরিচর্যা করে যাবেন বলে জানিয়েছেন ক্লাব কর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন