বাড়িতে অসুস্থ ছেলে, বিক্ষোভে তবু ছাড় পাননি মহিলা

তাঁর আড়াই বছরের ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আউশগ্রামের দিকনগর থেকে সোমবার জেলাশাসকের দফতরে এসেই সেই খবর পেয়েছিলেন ‘সোশ্যাল অডিট রিসোর্স পার্সন’ সুতপা ভাট্টাচার্য। তিনি জানান, আধিকারিকদের কাছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার অনুমতি পেলেও লাভ হয়নি।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৬
Share:

তাঁর আড়াই বছরের ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আউশগ্রামের দিকনগর থেকে সোমবার জেলাশাসকের দফতরে এসেই সেই খবর পেয়েছিলেন ‘সোশ্যাল অডিট রিসোর্স পার্সন’ সুতপা ভাট্টাচার্য। তিনি জানান, আধিকারিকদের কাছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার অনুমতি পেলেও লাভ হয়নি। কারণ সোমবার বিকেল ৪টের সময় অফিস থেকে বেরোতে গিয়ে আদিবাসী আন্দোলনের জেরে আটকে পড়েন। অভিযোগ, অনেক অনুনয়-বিনয়েও লাভ হয়নি। অবরোধ ওঠার পরে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছেন রাত সাড়ে ১১টায়।

Advertisement

একই অভিজ্ঞতা তাঁর সহকর্মী রত্না নায়কের। তাঁর যমজ সন্তানের ছোটটি দু’দিন ধরে অসুস্থ। দুবরাজপুরের বাসিন্দা জেলাশাসকের কার্যালয়ের ওই মহিলা কর্মীও সন্তানের অসুস্থতার জন্য একটু আগে ফিরতে চেয়েছিলেন। অভিযোগ, অনেক বার আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করেও অফিস থেকে বেরোতে পারেননি। বাড়ি ফিরেছেন রাত ১০টায়। সোমবার একই ভাবে জেলাশাসকের কার্যালয়ে আটকে পড়েছিলেন প্রোটেকশন অফিসার (ইন্সটিটিউশনাল কেয়ার), বোলপুরের বাসিন্দা সংযুক্তা ভট্টাচার্যও।

শুধু রত্না, সুতপা বা সংযুক্তাদেবীরা নন, সোমবার ভারত জাকাত মাঝি পারগাণা মহল নামে আদিবাসী সংগঠনের আন্দোলনের জেরে অফিসেই ঘন্টাপাঁচেক আটকে ছিলেন প্রায় ২৫০ কর্মী। নানা দাবি নিয়ে জেলাশাসকের কাছে একটি স্মারকলিপি দিতে এসেছিলেন আদিবাসী সংগঠনের নেতারা।

Advertisement

জেলাশাসক ও শীর্ষ সরকারি আধিকারিকেরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলা সফরের জন্য রামপুরহাটে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সংগঠনের নেতাদের দাবি ছিল, জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দিতে না পারলে নড়বেন না। শেষে রাত পৌনে ৮টায় রামপুরহাট থেকে ফিরে জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু স্মারকলিপি নেন। দাবি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। তার পরে রাত পৌনে ৯টা নাগাদ রেহাই মেলে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ এ ভাবে আটকে থাকায় সমস্যা পড়েন দূর থেকে আসা মহিলা কর্মীদের। তাঁদের অনেকেই এ দিন বলেছেন— ‘জেলাশাসককে স্মারকলিপি দিতে এসে এমন আন্দোলন কখনও দেখিনি।’

আর এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ— ‘তির ধনুক হাতে কয়েকশো আদিবাসীর দাপটে শুধু জেলাশাসকের কার্যালয় নয়, কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা জেলাসদর। বাস, অটোরিকশা, টোটো, মোটরবাইক সহ কোনও যানবাহনকেই রাস্তায় চলতে দেননি সংগঠনের সদস্যরা। যানজট ছিল, রাস্তায় আটকে গিয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্স। এমনকি বিয়েবাড়িতে মিষ্টি পৌঁছতে সমস্যা হয়েছে। নিমন্ত্রিতরাও সময়ে পৌঁছতে পারেননি।’ আচমকা এই আন্দোলন ঘিরে শহর জুড়ে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় বিরক্ত শহরবাসী। তাঁদের অনেকেই বলছেন— ‘এ ভাবে মানুষকে কষ্ট দিয়ে আন্দোলনের মানে কী? এমন তো নয়, স্মারকলিপি দিলেই সমস্যা মিটে যাবে।’ কেউ কেউ বলছেন— ‘আসলে সামনে লোকসভা ভোট। তার আগে আদিবাসীদের হটাতে বলপ্রয়োগ করতে চায়নি প্রশাসন।’

সুতপাদেবী বলেন, ‘‘বিকেল ৪টে থেকে আন্দোলনকারীদের কাছে বারবার অনুরোধ করেও ছাড় পাইনি। ছেলে অসুস্থ জানার পরেও কেউ ছাড়তে চাননি। এমনকী জেলাশাসক ম্যাডাম এসে যাওয়ার পরেও ১ ঘন্টা আটকে রেখেছিল।’’ রত্নাদেবীর অভিযোগ, ‘‘স্মারকলপি দিতে এসে এ ভাবে সমস্ত কর্মীদের পণবন্দি করা যায়, ধারণা ছিল না। খুব কষ্ট পেয়েছি অসুস্থ মেয়ের কথা ভেবে।’’ তবে তাঁরা ধন্যবাদ জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) দীপ্তেন্দু বেরাকে। আটকে থাকা কর্মীদের ফেরার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন তিনি।

প্রশাসনের দেওয়া গাড়িতেই রাত ১০টা নাগাদ বোলপুরে ফেরেন সংযুক্তাদেবীও। তিনি বলেন, ‘‘কাজের শেষে বাড়ি ফেরার তাগাদা থাকে। প্রত্যেকের নিজের নিজের মতো অসুবিধা, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু সোমবার অন্দোলনকারীরা কারও কথা শোনেননি।’’

উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থা এবং দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণ সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি বাসগুলি বিকেলের পরে থেকে শহরে ঢুকতে, বেরোতে পারেনি। প্রচুর যাত্রী সমস্যায় পড়েন। এমনকি ডব্লিউবিটিসি-র কলকাতা থেকে বোলপুর হয়ে এসি ভলভো বাসও বাসস্ট্যান্ডে আসতে পারেনি। একই অবস্থা ছিল বেসরকারি বাসস্ট্যান্ডে। আইএনটিটিইউসি-র জেলা কমিটির সদস্য রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘‘সন্ধ্যার পরে অনেক যাত্রীকে অটোরিকশা, টোটো করে শহর থেকে বাইরে যেতে হয়েছে।’’

কয়েকটি বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিতরাও কম এসেছেন। এমনই কথা জানান একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী মলয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ছেলের বৌভাত ছিল সোমবার। আয়োজন হয়েছিল শহর ঘেঁষা লজে। মলয়বাবুর বলেন, ‘‘বিকেল থেকে শহরের চার দিকে অবরোধের জেরে নিমন্ত্রিতদের ২০ শতাংশ আসতেই পারেননি। বাকিরা খুবই কষ্ট করে এসেছিলেন।’’

আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেন বলছেন, ‘‘আন্দোলন হয়েছে বলেই জেলাশাসক স্মারকলিপি নিয়েছেন। তবে অ্যাম্বুল্যান্স আটকে রাখা সমর্থন করা যায় না।’’

কেন এমন অন্দোলন?

ভারত জাকাত মাঝি পারগাণা মহলের নেতা নিত্যানন্দ হেমব্রম অবশ্য জোর করে মহিলাকর্মীদের আটকে রাখা, অ্যাম্বুল্যান্স আটকে রাখার অভিযোগ মানছেন না। তিনি বলেন, ‘‘১৫ দিন আগে জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিতে চেয়ে সময় নেওয়া হয়েছিল। তিনিই তারিখ দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আসবেন ভাল কথা। উনি ব্যস্ত থাকতেই পারেন। কিন্তু আমরা জানলাম না কেন!’’ তাঁর অভিযোগ, বঞ্চিত আদিবাসী সমাজের উপরে প্রশাসনের এই দৃষ্টিভঙ্গি, অবজ্ঞার জন্যই সোমবার এতক্ষণ ধরে অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে। না হলে তা হত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন