অসি শানাচ্ছেন দুই সহযোদ্ধা

এক জন যখন পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন, অন্যজন তখন ছিলেন সেই শহরেরই পুরপ্রধান। কিন্তু একই দলে থেকে প্রথম জনের রাজনৈতিক কৌশলে পুরপ্রধানের কুর্সি খোয়াতে হয়েছিল দ্বিতীয় জনকে। এ বার দু’জনে নির্বাচনী যুদ্ধে তাঁরাই পরস্পরের মুখোমুখি।

Advertisement

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০১:২৫
Share:

-কংগ্রেস প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের হাত ধরে মিছিলে উচ্ছ্বাস বাম নেতৃত্বের। তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে স্বমহিমায় ভোট ময়দানে হাজির শ্যামবাবুও।শুভ্র মিত্র

এক জন রাজনীতির মধ্যগগনে। অন্য জন রাজনৈতিক জীবনের স্বেচ্ছা নির্বাসন ভেঙে ফের ভোটের ময়দানে।

Advertisement

এক জন যখন পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন, অন্যজন তখন ছিলেন সেই শহরেরই পুরপ্রধান। কিন্তু একই দলে থেকে প্রথম জনের রাজনৈতিক কৌশলে পুরপ্রধানের কুর্সি খোয়াতে হয়েছিল দ্বিতীয় জনকে। এ বার দু’জনে নির্বাচনী যুদ্ধে তাঁরাই পরস্পরের মুখোমুখি।

প্রথমজন রাজ্যের বিদায়ী মন্ত্রী তৃণমূলের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আর দ্বিতীয়জন হলেন কংগ্রেসের প্রতীকে জোট প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য। এই দ্বৈরথ হঠাৎ করে একপেশে বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রের লড়াইকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

Advertisement

টানা ২৬ বছর ধরে বিষ্ণুপুরের মানুষ শ্যামবাবুকে পুরপ্রধান হিসেবে দেখে আসছেন। কিন্তু যাঁকে সরিয়ে তাঁর পুরপ্রধানের কুর্সি লাভ সেই তুষারকান্তি ভট্টাচার্যও পোড়খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রবীণরা মনে করিয়ে দেন, গোড়ায় শ্যামবাবু ও তুষারকান্তিবাবু দু’জনেই কংগ্রেস করতেন। তবে কংগ্রেসের ঐতিহ্য মেনে এই দুই নেতার আকচাআকচি ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৮৬ থেকে ’৯০ পর্যন্ত বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান ছিলেন তুষারকান্তিবাবু। শ্যামবাবু তখন নেহাতই একজন কাউন্সিলর। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা যে অন্যদের থেকে আলাদা, তা বুঝতে অনেক বাকি ছিল। পরেরবার ১৯৯০-এর পুরভোটে দু’জনেই জেতেন। কিন্তু সেই সময় কিছু কাউন্সিলরের সমর্থন আদায় করে তুষারবাবুকে সরিয়ে পুরপ্রধান হয়ে যান শ্যামবাবু। সেই শুরু। শ্যামবাবু পুরসভায় জাঁকিয়ে বসেন, হয়ে ওঠেন কংগ্রেসের জেলা সভাপতিও। দলে ক্রমশ কোণঠাসা হতে হতে কার্যত রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেন তুষারবাবু।

রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার, জেলাজুড়ে সিপিএমের দাপট, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বছরের পর বছর বিষ্ণুপুর শহরের ক্ষমতা কংগ্রেস ধরে রেখেছিল শ্যামবাবুর ক্যারিসমায়। রাজ্যে পালাবদলের হাওয়া শুরু হতেই কংগ্রেসের হাল ছেড়ে শ্যামবাবু ওঠেন মমতার নৌকায়। বিষ্ণুপুর পুরসভাও রাতারাতি কংগ্রেসের হাত থেকে চলে যায় তৃণমূলের দখলে। সেই থেকে এই শহরে এখন কংগ্রেসের ভোটপ্রাপ্তির হালও করুণ। কিন্তু শ্যামবাবুর বিরুদ্ধে তাঁর কট্টর বিরোধী তুষারবাবুকে এ বার ভোটে লড়িয়ে ম্যাচ জমিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস ও বামেরা। তুষারবাবুও রাজনৈতিক ছুঁতমার্গ ছেড়ে দুই হাতে কংগ্রেস ও সিপিএমের পতাকা আঁকড়ে গ্রামে-গঞ্জে প্রচারে নেমে পড়েছেন। কিন্তু বামেদের ধরেও এতদিনকার বাম-বিরোধী ওই কংগ্রেস নেতা এ বার ভোট বৈতরণী পার হতে পারবেন না বলে ঠাট্টা শুরু করছেন শাসকদলের কর্মীরা।

শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠেরা হিসেব দিচ্ছেন, গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে এই এলাকায় যতগুলি নির্বাচন হয়েছে সেখানে তৃণমূলের ভোট প্রাপ্তি ঊর্ধ্বমুখী। বিষ্ণুপুর পুরসভা থেকে এই বিধানসভা কেন্দ্রের অধীনে থাকা ন’টি গ্রাম পঞ্চায়েতই তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েত সমিতিও তাদের হাতে। জেলা পরিষদের দু’টি আসনও দখলে রেখেছে তৃণমূল। শ্যামবাবু পাঁচ বছর আগে সিপিএম প্রার্থী স্বপন ঘোষকে হারিয়েছিলেন ৯ হাজার ৮৫৭ ভোটে। গত লোকসভা ভোটে এই বিধানসভায় সেই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩৩৫। কংগ্রেসের ভোট যোগ করলেও ব্যবধান কমে হয় ১৮ হাজার ৯১৩। এই তথ্য তুলে ধরে তৃণমূলের বিষ্ণুপুর ব্লক সভাপতি মথুর কাপড়ির দাবি, ‘‘এরপরও জোটের লোকেরা বিষ্ণুপুরে জয়ের স্বপ্ন দেখে কী করে? এখানে আমরাই জিতব।’’

প্রশ্নটা এখানেই। একদিকে শ্যামবাবুর এই শহরে রাজনৈতিক কেরিয়ারের দীর্ঘ ছায়া। অন্যদিকে রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকা তুষারবাবুকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরাও চ্যালেঞ্জ। তাহলে কেন এ বারের লড়াই নিয়ে এলাকায় এত আলোচনা?

বিষ্ণুপুরের প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএম নেতা স্বপন ঘোষের দাবি, ‘‘২৬ বছরের পুরপ্রধান ও রাজ্যের মন্ত্রী হয়েও শ্যামবাবু এলাকার উন্নয়নে কিছুই করেননি। মানুষ তাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ইভিএমে জানিয়ে দেবেন।’’ গত কয়েকমাসের ঘটনাপ্রবাহে শাসকদলের অনেক কর্মীর আশঙ্কা, এ বার দলের দ্বন্দ্ব শ্যামবাবুকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে পারে।

এতদিন বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যামবাবু ও উপ পুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়কে কার্যত গলায়-গলায় দেখা যেত। কিন্তু তা যে কেটে গিয়েছে, শহরবাসী তা দেখেছেন। বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, শ্যামবাবু মন্ত্রীত্ব লাভের পরে বুদ্ধবাবুকে পুরপ্রধানের আসন ছাড়বেন বলে তাঁরা আশা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং বুদ্ধবাবুর গুরুত্ব যেন কিছুটা খর্ব হয়েছে। বিষ্ণুপুর হাসপাতালে কর্মী নিয়োগে বেনিয়মনের অভিযোগে বুদ্ধবাবু ও তাঁর অনুগামীদের বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনায় তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ প্রথমবার পেয়েছিলেন বিষ্ণুপুরের বাসিন্দারা। তা মাত্রাছাড়া চেহারা নেয় গত ১৩ জানুয়ারি। সে দিন বিষ্ণুপুর পুরভবনেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন শ্যামবাবু ও বুদ্ধবাবুর অনুগামীরা। অভিযোগ ওঠে, শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ দুই কাউন্সিলর ও এক দলীয় কর্মীর উপস্থিতিতে সেখানে বুদ্ধবাবুকে নিগ্রহ করা হয়। তার জেরে শহরে অবরোধ হয়, পথে নামে র‌্যাফ। শ্যামবাবু বা বুদ্ধবাবু অবশ্য ওই ঘটনাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। দু’জনেই প্রকাশ্যে তাঁদের মধ্যে কোনও সমস্যা রয়েছে বলে মানতে চাননি।

মাসখানেক আগেই শহরে সেফ ডেমোক্রেসির সভায় সিপিএম-কংগ্রেস নেতাদের পাশে দেখা যায় তুষারকান্তিবাবুকে। জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তখন থেকেই তাঁর নাম ছড়াতে থাকে। তুষারবাবুর সঙ্গে দলের কর্মীরা পথে নেমে দাবি করছেন, তাঁর আমলেই শহরের ঘরে ঘরে জলকলের সংযোগ হয়েছে। তৈরি হয়েছে পুর পর্যটন আবাস, রাস্তায় ভেপার ল্যাম্প জ্বলেছে, পানীয় জলের ট্যাংক বসেছে, ২৮টি প্রাথমিক স্কুল পাকা বাড়ি পেয়েছে চকবাজারে প্রথম মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। তুলে আনছেন, গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহরে মহিলা কলেজ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শ্যামবাবু মন্ত্রী হয়েও সেই কথা রাখতে পারেননি। মমতা বিষ্ণুপুরের পর্যটন উন্নয়নের নানা কথা শোনালেও শ্যামবাবু তার ছিটেফোঁটা কাজও ছিনিয়ে আনতে পারেননি।

যদিও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন শ্যামবাবু। তাঁর অনুগামীরা জানাচ্ছেন, পুরপ্রধান ও মন্ত্রী শ্যামবাবুর আমলে বিষ্ণুপুর শহর পেয়েছে পাকা ড্রেন, পাকা রাস্তা, সুইমিংপুল, হাসপাতালে নায্যমূল্যে ওষুধ দোকান, বার্ন ইউনিট, গ্রামীণ হাট, নির্মিয়মাণ যুব আবাস প্রভৃতি। শ্যামবাবুও বলছেন, ‘‘বিরোধীরা চিরকালই আমার বিরুদ্ধে রটনা করে। আমার সময়ে উন্নয়ন না হলে এতো বছর ধরে ভোটে জিতে আসছি কী করে?’’ আর তুষারবাবু শানাচ্ছেন, ‘‘পুরপ্রধান হিসেবে আমার কাজ মানুষ দেখেছেন। বিধায়ক হলেও বসে থাকব না। উন্নয়ন কাকে বলে মানুষ দেখতে পাবেন।’’

গত বিধানসভা ভোটে বিজেপি এই কেন্দ্রে ৩.৩৮ শতাংশ ভোট পেলেও লোকসভা ভোটে একলাফে তারা ১৮.০৮ শতাংশ ভোট টেনে নেয়। পুরভোটেও একটি ওয়ার্ডে তারা জিতেছে। কিন্তু এ বার তাঁদের প্রার্থী নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দলের কর্মীদের একাংশ মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের অভিযোগ, গত পুরভোটে পরাজিত নন্দদুলালবাবুকে প্রার্থী না করে দল অন্য কোনও উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রার্থী করলে ভাল ফল হতো। সম্প্রতি কর্মীদের বিক্ষোভে কর্মিসভাই ভণ্ডুল হয়ে যায়। প্রার্থী ও দলের নেতারা কোনওরকমে সভা ছাড়েন। নন্দদুলালবাবু অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘দল আমাকে প্রার্থী করেছেন। এটাই বড় কথা। আমি প্রচারে নেমে পড়েছি।’’ —

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন