বুক জল ঠেলেই যেতে হয় স্কুলে

মাথায় ব্যাগ। তাতে বইয়ের সঙ্গে ভরা স্কুলের পোশাক। হাতের প্লাস্টিকে জুতো। বর্ষায় ফুঁসে ওঠা পাতলই এখন শান্ত। কিন্তু সেতু না থাকায় সেই নদী পেরিয়ে স্কুলে এ ভাবেই বছরের বেশ কয়েকটা মাস যেতে হয় ছাত্রছাত্রীদের।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

হুড়া শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:১৭
Share:

জলে ভরা পাতলই নদী। জল না কমা পর্যন্ত এ ভাবে স্কুলে যাতায়াত করতে হয় পড়ুয়াদের। ছবি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

মাথায় ব্যাগ। তাতে বইয়ের সঙ্গে ভরা স্কুলের পোশাক। হাতের প্লাস্টিকে জুতো। বর্ষায় ফুঁসে ওঠা পাতলই এখন শান্ত। কিন্তু সেতু না থাকায় সেই নদী পেরিয়ে স্কুলে এ ভাবেই বছরের বেশ কয়েকটা মাস যেতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। সাধারণ মানুষকেও জল ভেঙে হেঁটেই পারাপার করতে হয়।

Advertisement

হুড়া ব্লকের কুলাবহাল পরমহংস যোগানন্দ বিদ্যাপীঠে যেতে দাপাং, সিজু, মাখনা-সহ কয়েকটি গ্রামের ছেলেমেয়েকে পাতলই নদী পার হতে হয়। বর্ষায় এই নদী ভরে যায়। তবে মাসখানেকের মধ্যেই জল অনেকটাই নেমে যায়। কিন্তু ওই কয়েকটা মাস এ ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যেতে হয়। নানা কাজে বাসিন্দাদেরও নদী পারাপার করতে হয়।

বাসিন্দারা জানান, দাপাং গ্রামের কাছে নদী কিছুটা চওড়া। সে কারণে নদীর গভীরতা কিছুটা কম। তাই সেখান দিয়েই তাঁরা নদী পারাপার করেন। কিন্তু কোমর সমান জল ঠেলে স্কুলে রোজ যাওয়া তো চাট্টিখানি
কথা নয়।

Advertisement

ছাত্রীদের কথায়, ‘‘কী করব? আমাদের এলাকায় টিউশন নেওয়ার সুযোগ নেই। যে টুকু পড়া, তা স্কুলেই হয়। তাই স্কুলে কামাই হলে পড়াশোনার খুব ক্ষতি। সে কারণে জল পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’’ দাপাং গ্রামের বাসিন্দা নবম শ্রেণির ছাত্রী গীতা মাহাতো ও দশম শ্রেণির সুশান্ত মাহাতোর কথায়, ‘‘বর্ষাকালে নদীর মতিগতি বোঝা দায়। সকালে দেখলাম হাঁটু সমান জল। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি এক কোমর জল হয়ে গিয়েছে। সবাই তখন হাত ধরাধরি করে নদী পার হই।’’

নদীর ওই মতিগতির জন্য ছাত্রীরা বর্ষায় ব্যাগে প্লাস্টিক ও গামছা রেখে দেয়। কোনও রকমে নদী পেরিয়ে ওপাড়ে গিয়ে তারা ঝোপঝাড়ে স্কুলের পোশাক পরে নেয়। দশম শ্রেণির সোমা মাহাতো, সুভদ্রা বাউরিদের কথায়, ‘‘ফেরার পথে স্কুলের পোশাকেই নেমে যাই। তখন তো আর পোশাক শুকনো রাখার ঝামেলা থাকে না।’’ তবে জল পার হতে গিয়ে অনেকে বিপদেও পড়ে। তারা জানাচ্ছে, স্রোতের ঠেলায় কখনও সখনও কারও ব্যাগ নদীর জলে পড়ে গিয়ে বইপত্রও ভেজে।

পাতলই নদীতে সেতু থাকলেও দাপাং গ্রাম থেকে তা বেশ দূরে। ছাত্রীরা জানায়, সেতু রয়েছে অনেক দূরে। অতদূর দিয়ে ঘুরপথে গেলে স্কুলের দেরি হয়ে যাবে। তাই নদী-পথ ধরেই যাতায়াত করে তারা।

তবে এ বার নদীতে কতদিন জল থাকবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ কিছুদূরে এই নদীর জল চেকড্যাম তৈরি করে বাঁধা হয়েছে। ফলে আগে বৃষ্টি ধরে গেলে দু-চারদিনেই জল নেমে যেত। এখন কিন্তু পুজোর পরেও জল থেকে গিয়েছে। সে কারণে এ বার নদীর জল কবে হাঁটুর নীচে নামবে, তা নিয়ে সংশয়ে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা।

এক ছাত্রীর কথায়, ‘‘চেকড্যামের সরু বাঁধের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়েও সমস্যা আছে। কয়েক সপ্তাহ আগে এক ছাত্রী সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। আমরাই কোনও রকমে তাকে
ধরে তুলেছি।’’

অভিভাবকদের মধ্যে অজিত মাহাতো, সমীর মাহাতোরা জানাচ্ছেন, ভিজে পোশাকো বেশিক্ষণ থাকার ফলে জ্বর-সর্দিতে ভোগে ছেলেমেয়েরা। এ দিকে সেতুও সেই ছ’-সাত কিলোমিটার দূরে কেশরগড়-গুড়দা মোড় এলাকায়। গ্রামবাসীর দাবি, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ওই এলাকায় নদীর উপরে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু পূরণ হয়নি। এই নদীর উপরে অন্তত একটি কজওয়ে তৈরি হলেও হুড়া ব্লক সদরের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই সহজ হতো। তৃপ্তি মাহাতো, সুতপা মাহাতো, সুভদ্রা বাউরি প্রমুখ ছাত্রীদের কথায়, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান একজন মহিলা। তাই তাঁকেই আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে সেতু তৈরির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানিয়েছি।’’

তবে জবড়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শ্রাবণী মণ্ডল বলছেন, ‘‘সেতু তো দরকার। কিন্তু সেতু তৈরি করার মতো তহবিল গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে নেই। আমি বিষয়টি নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির বৈঠকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।’’ হুড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুভাষ মাহাতো বলেন, ‘‘সেতু গড়ার কথা আমরা ভেবেছি। কিন্তু নদীর দু’পাশেই জমির সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলব।’’

অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডু পাশের মানবাজারের বিধায়ক। তিনি কী বলেন? তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওই এলাকা আমার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে পড়ে না ঠিকই। তবে বর্ষাকালে ছাত্রীদের নদীর তিরে পোশাক বদলে স্কুলে যাওয়াটা অস্বস্তিকর। খোঁজ নিয়ে দেখব কী করা যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন