সঙ্গীতা চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র
ছোটবেলা থেকেই চোখের সমস্যা ছিল সঙ্গীতার। কিন্তু সেই সমস্যাই আজ তাকে প্রায় দৃষ্টিহীন করে দেবে ভাবেনি!
সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে চরম আর্থিক সঙ্কট সঙ্গে নিয়েই ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ক্লাসের ‘ফার্স্ট গার্ল’ সঙ্গীতা চক্রবর্তী। অথচ এমন প্রতিভা সম্পন্ন মেয়ের ভবিষ্যতের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বোলপুর থানার পাঁচশোয়ার চক্রবর্তী পরিবার। তাঁদের চিন্তার কারণ, নিয়মিত সঙ্গীতার চিকিৎসা করাতে না পারলে, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েবে সে। একদিকে মেয়ের উচ্চ শিক্ষার খরচ, অন্যদিকে তার চোখের চিকিৎসা — এই দুইয়ের চিন্তায় দৃশ্যতই দিশেহারা পাঁচশোয়া চক্রবর্তী পরিবার।
ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় ভাল সঙ্গীতা। বরাবর গ্রামের স্কুলে, আশি থেকে নব্বই শতাংশ নম্বর নিয়ে ক্লাসের সেরা সে। চোখের সমস্যা নবম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনে কোনও দিন অন্তরায় হয়নি। নবম শ্রেণিতে প্রথমে বুঝতে পারে তার পরিবার। আর্থিক অভাবের কারণে চিকিৎসা করাতে পারেনি ফলে প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থার মধ্যেই কোনওমতে মাধ্যমিক দিয়েছিল সে। ২০১৪ সালে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়েছে সে।
সঙ্গীতার পরিবার জানিয়েছে, পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর নিজের ভাবনা থেকে লিখবে বলে কোনও ‘রাইটার’ নেয়নি সে। শুধু মাত্র প্রশ্ন পড়ার জন্য এবং লেখার সময়ে লাইন সঠিক হচ্ছে কি না দেখার জন্য ছোট বনকে সঙ্গে নেওয়া অনুমতি চেয়েছিল বোর্ডের কাছে। আর তাতেই ১৯৭৯ সালের পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠে এ যাবৎ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে সঙ্গীতা। সঙ্গীতার এ হেন সাফল্যে তার বাবা শ্যামাচরণ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে দাদু জগন্নাথবাবু এবং তার বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক তরুন চৌধুরী যতটা খুশি ততটাই চিন্তিত উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। সঙ্গীতার সফলতার কথা বলতে গিয়ে মা মালবিকা দেবী এবং দিদা শান্তি দেবীর চোখের জল যেন বাঁধ মানে না।
সঙ্গীতা বলে, ‘‘কখনও বাবা, মা আবার কখনও দাদু, দিদা। পরিবারের কাউকে না কাউকে থাকতেই হয় শারীরিক দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধকতার কারণে। পড়াশোনার সময়ে দাদু জগন্নাথ চক্রবর্তী সহায়তা জুগিয়ে এসেছেন। নিজে পড়তে পারলে আরও ভাল নম্বর আসত। কেউ পড়ে আর আমি শুনে শুনে মনে রাখি।’’
বাবা শ্যামাচরন চক্রবর্তী গ্রামে প্রাইভেট টিউশন পড়ান। তিনি বলেন, ‘‘শুধু মাত্র আর্থিক অভাবের কারণে এমন কৃতী ও মেধাবীর দৃষ্টিহীন দশা। প্রতি ছ’ মাস অন্তরে চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। চিন্তা সে নিয়েই। বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক সীতারাম মণ্ডল, আকাউন্টেন্সি শিক্ষক অমর সিংহরায়ের কাছে সার্বিক সহায়তা যেমন পেয়েছি, পড়াশোনায় দেখিয়ে দিতে এগিয়ে এসেছেন মামা সুদীপ্ত ভট্টাচার্য।’’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিতারাম মণ্ডল, প্রাক্তন শিক্ষক তরুন চৌধুরী এবং বর্তমানের শিক্ষক অমর সিংহরায়রা জানান, সঙ্গীতার জন্য কিছু করতে পারলে খুব ভাল লাগবে। কিন্তু কীভাবে জানে না সঙ্গীতা আর তার পরিবার। সেও তাই ভরসা রাখে দাদু জগন্নাথবাবু সান্ত্বনায়, আশ্বাসে।
জগন্নাথবাবু আশ্বাস সঙ্গীতা মনে করিয়ে দেন, ‘‘দাদু বলেছে, লড়াই করে এতটা পথ এগিয়েছিস, ঠিক বাকি পথটুকু ঈশ্বর দেখবেন! দাদুর কথায় নিজের উপর জোর পাচ্ছি!’’