যুযুধান। সিউড়ির ছোট আলুন্দায় ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক জেলায় বাড়ি। তায় আবার সহপাঠী। সেই ১৯৭৭ সালে কলকাতায় (এনআরএস-এ) ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বন্ধুত্ব হয় রামচন্দ্র ডোম ও অশোক চট্টোপাধ্যায়ের। বন্ধুত্বে মরচে ধরেনি আজও। দুই চিকিৎসক বন্ধুই এ বার সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে পরস্পরের মুখোমুখি।
একজন ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্দ্রিক জোটের পক্ষে সিপিএমের প্রার্থী। অন্য জন তৃণমূলের হয়ে ভোটের ময়দানে। বিজেপি-র জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই কেন্দ্রের প্রার্থী।
বিধানসভা ভোটের ইতিহাস, বাম-কংগ্রেসে সাম্প্রতিক বোঝাপড়ার কারণে রামবাবু ও অশোকবাবুর লড়াই ঘিরে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কেন, তা বোঝার আগে দেখে নেওয়া যাক বিধানসভা কেন্দ্রের ভৌগোলিক বিন্যাস। সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্রটির মধ্যে রয়েছে সিউড়ি পুরসভা-সহ গোটা সিউড়ি ১ ব্লক (খটঙ্গা, আলুন্দা, তিলপাড়া, কড়িধ্যা ,নগরী, মল্লিকপুর এবং ভূরকুনা। মোট সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা) রাজনগর ব্লক (রাজনগর, ভবানীপুর, গাংমুড়ি-জয়পুর, চন্দ্রপুর ও তাঁতিপাড়া মোট পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত) এবং দুবরাজপুর ব্লকের চারটি পঞ্চায়েত এলাকা (গোহালিয়াড়া, পারুলিয়া, চিনপাই এবং সাহাপুর)। মোট ভোটার ২,৩৫, ৮১৪ জন। মহিলা ভোটার ১, ১৫, ১৯৫।
তৃণমূলের বাড়বাড়ন্তের আগে পর্যন্ত এই এলাকায় কংগ্রেসের প্রভাব ছিল। বিধানসভার নির্বাচনের ইতিহাস বলছে, বাম আমলেও এক চেটিয়া ভাবে এই আসনের দখল বামেদের ছিল না। একাধিকবার সিউড়িতে জিতেছে কংগ্রেস। এই প্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী সিপিএমের কাছে হারলেও, ২০১১ সালের ভোটে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে প্রায় ২০ হাজার ভোটে জয়ী হন স্বপনকান্তি ঘোষ। গত লোকসভা ভোটের নিরিখেও বিধানসভায় এগিয়েছিল তৃণমূল। গত পুর নির্বাচনে তৃণমূল সিউড়ি পুরসভায় ক্ষমতায় আসে। এমনকী বিধানসভা এলাকায় থাকা ১৬টি পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে মাত্র তিনটি ছাড়া সবক’টি পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে। দুবরাজপুরের গোহালিয়াড়া, রাজনগরের গাংমুড়ি জয়পুর, সিউড়ির নগরী বামেদের।
রাজনীতির কারবারিরা অবশ্য মনে করছেন, এই পরিসংখ্যান দেখে যদি মনে হয় লড়াই কোথায়, হাসতে হাসতে জিতে যাবেন শাসকদলের প্রার্থী। তা হলে ভুল হবে। বীরভূমের যে যে আসনগুলিতে তৃণমূলের প্রার্থীদের জয় নিয়ে সংশয় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সিউড়ি কেন্দ্রেটি।
কেন এমন মত?
বিরোধী শিবিরের নেতারা একাধিক যুক্তি সাজিয়ে দিচ্ছেন। যার প্রথমটি হল বহিরাগত তকমা। রামপুরহাটের চিকিৎসক অশোক চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা নিয়ে সিউড়ি শহর তৃণমূলের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। প্রার্থী তালিকা প্রকাশের আগে স্থানীয় প্রার্থীর দাবি তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে পোস্টার পড়েছিল শহরে। জেলা রাজনীতির খোঁজ রাখেন এমন অনেকে বলছেন, ‘‘বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে চালানো হলেও তা আদতে টিকিট পেতে ইচ্ছুক এমন লোকজন বা তাঁর অনুগামীদের কাজ।’’ এই অংশটি অশোকবাবুকে জেতাতে ঝাঁপাবেই, সে নিশ্চয়তা কোথায়? বিধানসভা এলাকায় অশোকবাবুর পরিচিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এঁদের অনেকে।
অশোকবাবুর ক্ষেত্রে পরিচিত যদি সমস্যা হয় তা হলে সেই নিরিখেই এগিয়ে থাকছেন বামপ্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। সিপিএমের দাবি, বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা সাংসদ ছিলেন রামবাবু। সেই কারণে ওই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা সিউড়ি বিধানসভা এলাকাটি হাতের তেলোর মতো চেনেন তিনি। সজ্জন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ হিসাবেও পরিচিতি রয়েছে। তা ছাড়া জোটের প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের ভোটও (গত লোকসভা নির্বাচনে ৯৩৭৩ ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস) তাঁর ঝুলিতে পড়বে বলে আশাবাদী রামবাবু।
তৃণমূল শিবিরের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে ‘স্বপন-কাঁটা’। সিউড়ির তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করায় গত বছর বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষকে সাসপেন্ড করে দল। এরপর রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেন স্বপনবাবু। স্বপন-ঘনিষ্ঠদের দাবি, ‘‘এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক হিসাবে ওঁর প্রভাব থেকেই গিয়েছে। যেটা তৃণমূলের বিপক্ষে যেতেই পারে।’’
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, তৃণমূলের কাছে স্বপন-কাঁটা যদি অস্বস্তি হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব তবে ‘গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো’। বিধানসভা এলাকার পঞ্চায়েতগুলির বেশ কয়েক’টিতে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলের চোরাস্রোত হয়েছে। যেমন সিউড়ি ১ এর ভূরকুনা। স্থানীয় কিছু নেতার হঠাৎ ফুঁলে ফেঁপে ওঠা মেনে নিতে পারছেন না দলের কর্মী সমর্থকদের বড় অংশ। তৃণমূলের সূত্রেই খবর, সমস্যা রয়েছে চিনপাই, সাহাপুর, ক়ড়িধ্যার মতো পঞ্চায়েতগুলিতে। জেলা তৃণমূলের এক নেতা ঘনিষ্ঠ মহলে এর সত্যতা মেনেও নিয়েছেন।
তবে জোট-প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন এমনটা মনে করছেন না অনেকেই। তার পয়লা কারণ হল নেতিয়ে পড়া সংগঠন। অভিযোগ, সমর্থক থাকলেও কর্মীর অভাবে শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোট প্রচারে জোর তুলতে পারছেন না নেতৃত্ব। অনেকেই মনে করছেন জেতা-হারায় ফারাক গড়ে দিতে পারে সিউড়ি পুর এলাকা এবং গত লোকসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটে থাবা বাসানোর অঙ্ক। বিজেপি নেতারা অবশ্য আশাবাদী তারকা প্রার্থী জয় সব হিসেব উলোটপালোট করে দিতে পারেন।
গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল ৭৩,৯০৪ ভোট, সিপিএম পেয়েছিল ৫৫, ৯৩৭। সেখানে বিজেপি পেয়েছিল ৪১, ৪৯৬টি ভোট। কংগ্রেসের প্রাপ্তভোট ছিল ৯৩৭৩। বিজেপি নেতাদের দাবি উড়িয়ে বাম-কংগ্রেস ও শাসকদলের নেতারা পাল্টা দাবি করছেন, গত লোকসভায় প্রাপ্ত ভোট কোনও ভাবেই রাখতে পারবে না বিজেপি। তারকা প্রার্থী দাঁড় করিয়েও কতটা লাভবান হবে বিজেপি, সে সন্দেহ রয়েছে তাঁদের মনে। বিজেপি নেতারা অবশ্য জোর গলায় দাবি করছেন, বক্রেশ্বর থেকে সিউড়ির কড়িধ্যা এবং রাজনগরে প্রচুর ভোট তাঁরা পাবেন। তবে জেতা নিয়ে সংশয় রয়েছে নেতৃত্বের মনেও।
আর ভোট-ময়দানে মুখোমুখি চিকিৎসক দুই বন্ধু বলছেন, ‘‘এটা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর লড়াই নয়। লড়াই নীতি আদর্শের।’’ ‘‘আমরা স্বাস্থ্যের লোক। স্বাস্থ্যকর লড়াই চাই’’— বলছেন তাঁরা। তা কতটা স্বাস্থ্যকর হবে, সময় বলবে। তবে লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি, এলাকায় কান পাতলেই টের পাওয়া যাচ্ছে তার।