কেন পালাতে বললাম না, আক্ষেপ স্ত্রীর

রাতের কালো আকাশ চিরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। ভারী বৃষ্টি নামবে। মহিষমুড়া গ্রামের সব বাড়ির আলো একে একে নিভে গিয়েছে। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে সাত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন সুবল তাঁতি।

Advertisement

দেবব্রত দাস

বারিকুল শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৩৩
Share:

নিজস্ব চিত্র

• রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় বারিকুলের মহিষমুড়া গ্রামের সিপিএম কর্মী সুবল তাঁতিকে

Advertisement

• দেহের কাছে মেলে মাওবাদীদের পোস্টার। নিহতকে তারা পুলিশের চর বলে আখ্যা দিয়েছিল।

• ঘটনায় জড়িত সন্দেহে একজনকেই পুলিশ গ্রেফতার করে।

Advertisement

• চার্জশিটে কোনও প্রমাণ দাখিল করতে না পারায় ধৃতের জামিন।

রাতের কালো আকাশ চিরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। ভারী বৃষ্টি নামবে। মহিষমুড়া গ্রামের সব বাড়ির আলো একে একে নিভে গিয়েছে। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে সাত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন সুবল তাঁতি। হঠাৎ নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। বাইরে থেকে ডাকাডাকি শোনা গেল, ‘‘সুবলদা, বাড়ি আছো? দরজা খোলো।’’

ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ় সিপিএম কর্মী। দরজা খুলে দেখলেন, এক চিলতে উঠোনে ভিড় করেছে জংলা পোশাক পরা এক দল যুবক। সবার হাতেই বন্দুক। সুবলবাবুকে জোর করে টেনে নিয়ে চলে গিয়েছিল তারা। পরের দিন সকালে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে পুকুরের পাড় থেকে তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পেশায় দিনমজুর সুবলবাবুর দেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল মাওবাদী পোস্টার। পুলিশের চর সন্দেহে তাঁকে খুন করে মাওবাদীরা।

দিনটা ছিল ২০১০ সালের ১১ অগস্ট। লালগড় আন্দোলন তখন কিছুটা স্তিমিত। যৌথ বাহিনীর লাগাতার অভিযানে কিছুটা পিছু হটেছে মাওবাদীরা। কিন্তু কিষেণজির দাপটে তাতে চিড় ধরেনি। গভীর জঙ্গলের পথ ধরে বাঁকুড়ার বিভিন্ন গ্রামে আনাগোনা করত মাওবাদীরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানা ঘেঁষা বারিকুল থানার মহিষামুড়া গ্রামেও ছিল তাদের যাতায়াত। জঙ্গলমহলের সিপিএমের নেতারা আশঙ্কায় থাকতেন সর্বক্ষণ।

কিন্তু, সাধারণ সিপিএম কর্মী হয়েও যে জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে, দিন আনা দিন খাওয়ার মাঝে সে আশঙ্কা ঠাঁই পায়নি সুবলবাবুর পরিবারের লোকজনের চিন্তায়। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই দিন মহিষামুড়া গ্রামে হানা দিয়েছিল মাওবাদীদের বারিকুল স্কোয়াড। তারা সুবলবাবুকে তুলে নিয়ে যায় গ্রামের শেষ প্রান্তে, বড়বাঁধের পাশে। মাথায়, বুকে গুলি করে খুন করে পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়কে। মৃতদেহের পাশে পড়েছিল মাওবাদী পোস্টার। তাতে লেখা ছিল, ‘‘পুলিশের চর সুবল তাঁতিকে গণ আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হল।’’

১২ অগস্ট বারিকুল থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন নিহতের ভাই ধুবল তাঁতি। কেস নম্বর ২৪/২০১০। অজ্ঞাত পরিচয় ১৫-১৬ জনের বিরুদ্ধে রুজু হয় খুনের মামলা। সিপিএম নেতৃত্ব এবং নিহতের পরিবার প্রথম দিন থেকেই দাবি করে এসেছে খুনের পিছনে রয়েছে মাওবাদীরাই। তদন্তে উঠে আসে মাওবাদী নেতা কিঙ্কর পাল-সহ কয়েকজন স্কোয়াড সদস্যের নাম। কিঙ্কর পালকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। ধরা যায়নি আর কাউকেই। উদ্ধার হয়নি অস্ত্র।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাজ্যে পালাবদল হয়। তারপরে গত সাড়ে পাঁচ বছরে জঙ্গলমহলের ছবিটা অনেক বদলে গিয়েছে। মাওবাদীদের সেই দাপট আর নেই। খুনের প্রায় এক বছর পরে চার্জশিট জমা দিয়েছিল পুলিশ। তাতে জানানো হয়, ধৃতের বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার সরাসরি প্রমাণ মেলেনি। পরে কিঙ্কর পাল জামিনে মুক্তি পান। হিজিলি গ্রামের বাসিন্দা কিঙ্কর পাল এখনও দাবি করেন, খুনের ঘটনার সঙ্গে তিনি কোনও ভাবেই যুক্ত নন।

সেই সন্ধ্যার কথা আজও তাড়া করে বেড়ায় নিহতের স্ত্রী, ছেলে, মেয়েদের। সুবলবাবুর দুই ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের নিচুতলার সাধারণ কর্মী হওয়া সত্ত্বেও ছাপোষা গৃহস্থ সুবলবাবুর উপর কেন নেমে এসেছিল আক্রমণ তা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি তাঁরা। দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় বসে চোখের জল ফেলেন নিহতের স্ত্রী জ্যোৎস্নাদেবী। আজও তিনি অনুতাপ করেন, ‘‘ওরা গামছায় মুখ ঢেকে এসেছিল। কে ডাকছে বুঝতে পারিনি। তখন যদি জানতাম প্রাণে মেরে ফেলবে, তাহলে দরজা না খুলে পালিয়ে যেতে বলতাম। আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার স্বামীকে টেনে নিয়ে গেল। বাধাও দিতে পারিনি। ’’

নিহতের ভাই ধুবলবাবুর আক্ষেপ, “কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষতিপূরণের তিন লক্ষ টাকা পেয়েছি। যারা সন্ত্রাস করল, খুন করল, রাজ্য সরকার তাদের চাকরি দিল। আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি সে দিকে ফিরেও দেখল না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন