এই বুঝি চাঙড় খসল মিউজিয়ামে

রুগ্‌ণ বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন

রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অন্তর্গত প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিষ্ঠানের এমন দশা কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অবিলম্বে সংস্কারের দাবি তুলেছেন তাঁরা।

Advertisement

শুভ্র মিত্র

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৪
Share:

ফাটল ধরেছে ছাদে। বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের অবস্থা। নিজস্ব চিত্র

এ যেন বিষ্ণুপুরের মধ্যে ছোট্ট বিষ্ণুপুর। দেওয়াল জুড়ে থরে থরে সাজানো শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের ছবি, প্রাচীন নিদর্শন। জেলার অন্য এলাকারও বহু ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু, ছাদে চোখ গেলেই মন খারাপ হয়ে যায় ইতিহাস পিপাসুদের। বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের (জেলা সংগ্রহশালা) ছাদের অনেক জায়গাতেই প্যালেস্তারা খসে পড়েছে। কোথাও ফেটে গিয়েছে ছাদ, বেরিয়ে পড়েছে রড। সব মিলিয়ে পর্যটকদের কাছে বেআব্রু হয়ে পড়েছে ইতিহাস-সমৃদ্ধ জেলার জাদুঘরের করুণ অবস্থা।

Advertisement

রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অন্তর্গত প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিষ্ঠানের এমন দশা কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অবিলম্বে সংস্কারের দাবি তুলেছেন তাঁরা। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) মানস মণ্ডলের আশ্বাস, ‘‘ইতিমধ্যেই রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর থেকে বিষ্ণুপুর পূর্ত দফতরে চিঠি দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি পরিকল্পনা রিপোর্ট তৈরি করে সংস্কারের কাজে নামা হবে।’’

শিকড়ের পরিচয় না পেলে মানব সভ্যতা ঠিক পথে এগোয় না— এই বোধ থেকেই বিষ্ণুপুরকে ভালবেসে, ভাবী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করতে ৫৩ জন উদ্যমী মানুষ গড়ে তুলেছিলেন আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন। পরে ২০১০ সালে তা বাঁকুড়া জেলার সংগ্রহশালা হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

Advertisement

পুরাকৃতি ভবনের পরিচালন সমিতির সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত জানান, শিক্ষক তথা পুরাতাত্ত্বিক মানিকলাল সিংহের হাত ধরে তাঁরা একটি সংগ্রহশালা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথমে বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হস্টেলে তাঁরা সংগ্রহশালা শুরু করেন। সেই সময়ে অজিত ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, শ্রীদাম দাশগুপ্ত, লক্ষ্মীকান্ত নাগ, সত্যব্রত দে প্রমুখ প্রায় ৫৩ জনের একটি দল মানিকবাবুর নেতৃত্বে ইতিহাস জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতেন। কখনও হেঁটে, কখনও গরুর গাড়িতে চেপে। অনেক সময় কিছু গ্রামের বাসিন্দার তাড়াও খেতে হয়েছে তাঁদের। এমনকি তাঁদের কারও কারও নামে থানায় অভিযোগও হয়েছে। জয়পুরের সলদা, মোলকারি, ইঁদপুর, শ্যামনগর, অম্বিকানগর, কাঁকিল্যা, অযোধ্যা, গোকুলনগর প্রভৃতি গ্রাম থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন প্রাচীন মূর্তি, পুথি। দেখতে দেখতে ইতিহাসের প্রচুর নিদর্শন তাঁরা উদ্ধার করেন।

চিত্তবাবু বলেন, ‘‘তখন এত মূর্তি, পুথি উদ্ধার হয়েছিল যে, রাখার জায়গা খুঁজে পেতাম না। সেই সময় আমরা একটি মিউজিয়াম তৈরির পরিকল্পনা করি।’’ তিনি জানান, মিউজিয়ামের জন্য বিষ্ণুপুরের বনেদি পরিবার মল্লেশ্বরের ভট্টাচার্যরা দশ কাঠা জমি দান করেন। ১৯৬০ সালে সংগ্রহশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর। বিষ্ণুপুরবাসীর অর্থ সাহায্যে এক তলায় শুরু হয় সংগ্রহশালা। ১৯৭৪ সালে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উদ্বোধন করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিষ্ণুপুর শাখার পরিচালনায় শুরু হয় সংগ্রহশালার কাজ। সেই সময়ে এসেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, সমরেশ বসু, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, রাজ্যপাল নুরুল হাসান ও গোপালকৃষ্ণ গান্ধী প্রমুখ।

কী কী রয়েছে?

কিউরেটর তুষার সরকার জানান, সংগ্রহশালায় আছে পাঁচটি গ্যালারি: ১) প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, ২) বিষ্ণুপুর সঙ্গীত ঘরানার গ্যালারি, ৩) লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের গ্যালারি, ৪) নৃতত্ত্বের গ্যালারি ও ৫) আলোকচিত্রের গ্যালারি। এখানে রয়েছে বহু প্রাচীন পুথিও। মধ্যযুগের আয়ুর্বেদের পুথিই বেশি। রয়েছে ব্যাকরণ শাস্ত্র ও সংস্কৃত সাহিত্যের পুথিও। তালিকাভুক্ত এবং নামকরণ হয়েছে এমন পুথির সংখ্যা তিন হাজারের উপর। ১৩০টি প্রত্ন-ভাস্কর্য আছে। আছে বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত মানুষদের ব্যবহৃত সঙ্গীত সরঞ্জাম, ছবি। দেশের নানা জায়গা থেকে বহু আগ্রহী গবেষকের এখানে আসা যাওয়া রয়েছে।

কিন্তু, এত গুরুত্বপূর্ণ এই মিউজিয়ামের রুগ্ন দশা ধরা পড়ে বছরখানেক আগেই। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, সিলিং থেকে অনেক ঘরেই চাঙর খসে পড়েছে। কোথাও ফাটল ধরেছে। মৌচাকের বাসাও রয়েছে। রেন ওয়াটার পাইপ ভেঙে জল দেওয়াল ক্ষতি করছে।

পাশের সরকারি পলিটেকনিক কলেজের বড় গাছ গা ঘেঁষে বাড়ছে। পলিটেকনিক কলেজের নিকাশি জলও বয়ে যায় সংগ্রহশালার পাশ দিয়ে।

চিত্তরঞ্জনবাবুর চিন্তা, ‘‘বহু অমূল্য সম্পদ আছে এখানে। বিষ্ণুপুরকে জানতে, চিনতে হলে অবশ্যই আসতে হবে এখানে। এখনও মহকুমা প্রশাসন কোথাও প্রাচীন মূর্তি পেলে এখানে পাঠান। সাধারণ মানুষ যাঁরা ইতিহাস সচেতন, কোথাও বিরল প্রাচীন পুথি, পুরাতত্ব নিদর্শন পেলে সযত্নে সংগ্রহশালায় আনেন। তাই এই ভবন রক্ষা না করা গেলে এত মানুষের বাঁচানো প্রত্নসম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে।’’

পূর্ত দফতরের বিষ্ণুপুরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বাসব দত্ত বলেন, ‘‘ডিরেক্টর অব হেরিটেজ কমিশন চিঠি দিয়ে ওন্দার শ্যামচাঁদ মন্দির ও আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন সংস্কার করতে বলেছে। পরিদর্শন শেষে বিস্তারিত পরিকল্পনা রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement