তিনিই দুর্গা। তিনিই অপরাজিতা। তবে, তিনি চতুর্ভুজা। হাতে হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা। গায়ের রং নীল। ত্রি নয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা। বিজয়া দশমীর দিন দুর্গা মন্ত্র বিসর্জনের পরে মণ্ডপের ঈশাণ কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতা লতা রেখে এই দেবীর পুজো হয়। কিন্তু মুরারইয়ের কণকপুর গ্রামে অপরাজিতা মায়ের মন্দিরে সপ্তমী থেকে দশমী অবধিই দুর্গার ধ্যানে পুজো হয়। আর ওই পুজো ঘিরেই শুধু বীরভূমই নয়, সামীনা লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকেই বহু পুণ্যার্থী কনকপুরে ভিড় করেন।
মন্দিরের অছি বোর্ডের সহ-সম্পাদক তথা কণকপুর হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রামকৃষ্ণ সিংহ জানান, ঝাড়খণ্ডের দিগনগর এলাকার জমিদার উদয়নারায়ণ এই মন্দিরের সেবাইত ছিলেন। ১৭১৪ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ-র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। উদয়নারায়ণের কণকপুর এলাকার জমিদারি নাটোরের রাজা রখনন্দনের হেফাজতে চলে যায়। তখন ঝাড়খণ্ডের মহেশপুরের রাজার আশ্রিতা হরবংশী বর্মণ্যা এই অপরাজিতা মায়ের মন্দিরটি নতুন করে সংস্কার করেন। মুরারই এ কে ইনস্টিটিউশনের ইতিহাসের প্রাক্তন শিক্ষক রণজিত সিংহ আবার বললেন, “দুর্গাপুজোর সময় পীঠ দেবতাগণের পুজোর সময় কণকপুরবাসী অপরাজিতা দেবীর পুজোর উল্লেখ আছে। অনেকের ধারণা কণকপুর গ্রামের নামটি দক্ষিণ ভারত থেকে আসা।” তিনি জানান, বাংলায় বর্গী আক্রমণের সময় অপরাজিতা মায়ের মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আজ যেখানে অপরাজিতা মায়ের মন্দির আছে, সেখান থেকে পশ্চিমে খাঁড়পুকুর নামে একটি পুকুরে মূর্তির এক অংশ পড়েছিল। পরে পুকুর খনন করে চা পাওয়া যায়। এখনও অপরাজিতা মন্দিরের পাশে শিব মন্দিরে ওই ভগ্ন পাথর রাখা আছে।” মুরারইয়ের বাসিন্দা অশোক মুখোপাধ্যায় জানালেন, ১০০ বছর আগে কাশী থেকে অপরাজিতা মায়ের মুখ নিয়ে এসে নতুন করে স্থাপন করা হয়। জনশ্রুতি আছে, সতীর কণককুণ্ডল পড়েছিল, সেই জন্য এই গ্রামের নাম কণকপুর। আবার কণকপুর গ্রামের অপরাজিতা মা উপপীঠের দেবী বলেও এলাকাবাসী মনে করেন। মন্দিরের অছি বোর্ডের সভাপতি পান্নালাল দত্ত জানান, নির্গুণানন্দ মহারাজ এখানে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মন্দিরে এবং গ্রামে অনেকের ঘরে তাঁর ছবি আছে।
দেবী প্রায় চার ফুট উঁচু বেদীতে অধিষ্ঠান করে আছেন। মূর্তির মধ্যে কেবল মুখমণ্ডল নিয়ে অপরাজিতা মায়ের মূর্তি। কণকপুরে সেই মূর্তিকে ঘিরেই পুজো হয়। দুর্গার অন্য কোনও মূর্তি গড়ে পুজো হয় না। অছি বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ অচিন্ত্য সিংহ জানান, পুজো দেখতে ঝাড়খণ্ড, বিহার থেকেও মানুষের ঢল নামে। মায়ের পুজো দেখতে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য আলাদা করে মন্দিরের সামনে মণ্ডপ করতে হয়। গ্রামে আরও তিনটি পুজো হলেও অপরাজিতা মায়ের মন্দিরে পুজো এলাকাবাসীর কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। মন্দির চত্বর লাগোয়া এলাকায় গ্রামীণ মেলা বসে। দুর্গাপুজো ছাড়া রটন্তী কালীপুজোর সময় অপরাজিতা মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণ ভক্তজনের কাছে একটি বার্ষিক মিলন উত্সব হয়ে দাঁড়ায়।
মুরারই থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরের এই গ্রামে অপরাজিতা মায়ের মন্দির এবং তার আশপাশ বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি বাসিন্দাদের।