অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মল্লরাজের কীর্তি

সে প্রায় চারশো বছরের আগের কথা। চারপাশে ধূ ধূ প্রান্তর, আর জঙ্গল। একপাশে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর নদ আর আমোদর। পাঠান-মোঘল সেনাদের রক্তে সেই সময় রাঙা হয়ে উঠেছিল কোতুলপুর। তারপর দ্বারকেশ্বর-আমোদরের উপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে এখনও রয়ে গিয়েছে কোতুলপুরের নাম।

Advertisement

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

কোতুলপুর শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩৭
Share:

ভদ্রবাড়ির মন্দির। সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শনের সাক্ষী এই মন্দির। (ইনসেটে) মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ। ছবি: শুভ্র মিত্র

সে প্রায় চারশো বছরের আগের কথা।

Advertisement

চারপাশে ধূ ধূ প্রান্তর, আর জঙ্গল। একপাশে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর নদ আর আমোদর। পাঠান-মোঘল সেনাদের রক্তে সেই সময় রাঙা হয়ে উঠেছিল কোতুলপুর। তারপর দ্বারকেশ্বর-আমোদরের উপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে এখনও রয়ে গিয়েছে কোতুলপুরের নাম।

আসলে কোতুলপুর নামকরণের পিছনে ওই যুদ্ধের সূত্র রয়ে গিয়েছে। ‘কোতুলপুর ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের লেখক লক্ষ্মীকান্ত পাল জানাচ্ছেন, ১৫৯০ সালে উত্তর ওড়িশার অধিপতি আফগান শাসক কতলু খান লোহানীর সঙ্গে এই অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছিল মুঘল সেনাপতি মানসিংহের পুত্র জগত সিংহের। পাঠান সেনানায়ক বাহাদুর কুরুর চক্রান্তে জখম হয়েছিলেন জগত সিংহ। তাঁকে উদ্ধার করে বিষ্ণুপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন মল্লরাজা বীর হাম্বীর। কিন্তু রটে গিয়েছিল ওই যুদ্ধে জগত সিংহ মারা গিয়েছেন। সে সংবাদ শুনে কতলু খানের বিরুদ্ধে নিজে অস্ত্র ধরেন মানসিংহ। যুদ্ধ জয়ের ১০ দিনের মাথায় প্রাণ যায় কতলু খানের। জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁর দেহ এখানেই কবর দেহ দেওয়া হয়। তাঁকে কোতল করা হয়েছিল বলে সেই থেকে এই জনপদের নাম কোতুলপুর।

Advertisement

তবে কোতুলপুরের নাম ইতিহাসের পাতার উঠে এসেছে তারও ঢের আগে। সে অষ্টম শতকের কথা। বিষ্ণুপুরের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করেছেন চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “অষ্টম শতকের মল্লরাজ্যের সূচনা হয়েছিল কোতুলপুরের লাউগ্রামে। সেই সময় কোতুলপুর ও তার লাগোয়া গ্রামগুলি একে একে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে মল্লরাজারা বিষ্ণুপুরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। কিন্তু ইতিহাস উপেক্ষা করতে পারেনি কোতুলপুরকে। পাঠান-মুঘল সেনাদের লড়াইকে ঘিরে ফের উঠে আসে এই জনপদের কথা। ওই যুদ্ধের পরেই দিল্লির অধিপতি আকবরের সঙ্গে মল্লরাজাদের হৃদত্য গড়ে ওঠে। মল্লরাজ্য এগিয়ে যায় জাহানাবাদ (অধুনা আরামবাগ) পর্যন্ত।”

সে সময়ে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে সম্পন্ন কিছু ব্যবসায়ীরও বাস ছিল এখানে। তাঁদের অনেকে মশলাপাতির ব্যবসা করতেন। কোতুলপুর প্রথমে বর্ধমান ও পরে হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল। পরে ১৮৮১ সালে বাঁকুড়া জেলা গঠিত হওয়ার পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় এই জনপদ। হুগলি জেলা লাগোয়া বাঁকুড়ার এই ব্লক সদর এখন অনেক বদলে গিয়েছে। চাষবাসে বেশ সমৃদ্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যেও অন্য কয়েকটি ব্লক সদরের থেকে কোতুলপুর এগিয়ে রয়েছে। দিন দিন বসতিও বাড়ছে।

তবে ইতিহাস মুছে যায়নি। একটি অসাধারণ পঞ্চরত্ন মন্দির রয়েছে ভদ্র পাড়ায়, নাম শ্রীধর ঠাকুরের মন্দির। উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৩৩ সাল। ওই মন্দিরের সামনের দেওয়ালে রয়েছে টেরাকোটার পৌরাণিক কাহিনীর নিখুঁত অলঙ্করণ। ওই মন্দিরের পাশেই রয়েছে গিরিগোবর্ধনের মন্দির, উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন চুন-বালির মিশ্রণে তৈরি এই মন্দির গাত্রের দ্বারপাল, কৃষ্ণ, কালী ইত্যাদি মূর্তিগুলি। তবে মন্দিরগুলির গায়ে কোনও প্রতিষ্ঠা ফলক নেই। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় ব্রতী এলাকার বাসিন্দা লক্ষ্মীকান্ত পালের অভিমত, “এই মন্দিরটিও পাশের শ্রীধর মন্দিরের সমসাময়িক।”

এই মন্দির দু’টির প্রতিষ্ঠাতা ভদ্র পরিবার। ওই পরিবারের সদস্য হরেরাম ভদ্র জানান, খুব সম্ভবত সপ্তদশ শতকে তাঁদের পূর্ব পুরুষরা বর্ধমানের মরাল গ্রাম থেকে এখানে উঠে এসে নুন, তামাক, সুতো ও সর্ষের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় লাভের মুখ দেখার পর তাঁরা ওই মন্দিরগুলি গড়ে তোলেন। ওই মন্দির সংলগ্ন দুর্গাদালানটি দেখিয়ে হরেরামবাবু বলেন, “১২৮২ বঙ্গাব্দে এই মন্দিরে দুর্গোত্‌সব শুরু হয়। তার কয়েক বছর পরে ১২৮৭ সনে পরম পুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব এখানকার পুজোয় আরতি দর্শন করেন বলে শোনা যায়।” ভদ্র পরিবারের ১৭ চূড়া যুক্ত রাসমঞ্চটিও দৃষ্টিনন্দন। এ ছাড়া বেনে পাড়ায় অবস্থিত অষ্টাদশ শতকে তৈরি নবরত্ন দামোদর মন্দির, ষোড়শ শতকে তৈরি উত্তর পাড়ার রাধারমণ জিউ মন্দির ও হালদার পাড়ায় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বিষ্ণুমন্দির সমান ভাবেই দর্শনীয়।

এইসব পুরাকীর্তি বা স্থাপত্যের পাশাপাশি এলাকার পূজা-পার্বণ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ। দুর্গাপুজো ছাড়াও রাস, গাজন মেলা, শীতলা-মনসা পুজো ও তুষু-ভাদু গানেরও চল রয়েছে। এখানকার তাঁত বস্ত্র, শোলা, বেলমালা, শাঁখ ও মাটির কাজ তারিফ করার মতো। কিন্তু এখানকার মন্দির শৈলি বা শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সরকারি প্রয়াস চোখে পড়েনি বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষজন। কোতুলপুর ভদ্র পাড়া এলাকার বাসিন্দা গৌরবরণ খাঁ, শান্তি রায় বলেন, “সরকারি ভাবে প্রচার নেই বলেই এমন অনবদ্য শৈলির মন্দির দেখতে এখানে পর্যটকেরা ভিড় করেন না। নিজেদের সৃষ্টিকে মেলে ধরার সুযোগ পান না হস্তশিল্পীরাও।” মন্দিরগুলি সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কোতুলপুরের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি নিমাই ঘোষ বলেন, “এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে বারবার দরবার করেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।”

তবে কোতুলপুরের তৃণমূল বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা আশ্বাস দিয়েছেন, “পর্যটক টানতে এলাকার ঐতিহাসিক ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার নিয়েও কী কী নতুন পদক্ষেপ করা যায় তারও সামগ্রিক পরিকল্পনা চলছে। শীঘ্রই তার সুফল মিলবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন