ও দিদিমা বাড়ি যাও, তোমার ভোট পড়ে গেছে

দৃশ্য ১: লাভপুরের দাঁড়কা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথ। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ওই বুথ থেকে কিছুটা দূরে দেখা মিলল স্থানীয় ধীবরপাড়ার ৭০ বছরের বৃদ্ধার। বুড়িমা ভোট দিয়েছেন? আগন্তুকের প্রশ্নটা শুনে চোখ কুঁচকে গেল। সাদা শাড়ির খুঁটে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “সকাল ১০টায় স্লিপ হাতে বুথে পৌঁছতেই তৃণমূলের ছেলেরা বলল, দিদিমা তোমার ভোট হয়ে গিয়েছে। তুমি বাড়ি চলে যাও। কষ্ট করে আর রোদে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হবে না!”

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

লাভপুর শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০২:৪৪
Share:

নানুরের দাশকলগ্রামে ফাঁকা বুথ। বুধবার। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

দৃশ্য ১: লাভপুরের দাঁড়কা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথ। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ওই বুথ থেকে কিছুটা দূরে দেখা মিলল স্থানীয় ধীবরপাড়ার ৭০ বছরের বৃদ্ধার।

Advertisement

বুড়িমা ভোট দিয়েছেন?

আগন্তুকের প্রশ্নটা শুনে চোখ কুঁচকে গেল। সাদা শাড়ির খুঁটে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “সকাল ১০টায় স্লিপ হাতে বুথে পৌঁছতেই তৃণমূলের ছেলেরা বলল, দিদিমা তোমার ভোট হয়ে গিয়েছে। তুমি বাড়ি চলে যাও। কষ্ট করে আর রোদে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হবে না!”

Advertisement

দৃশ্য ২: নানুরের খুজুটিপাড়া। দুপুর ২টো। এক সময়ের প্রভাবশালী সিপিএম নেতার বাড়ি লাগোয়া একটি পরিবারের সদস্যেরা জানালেন, গত কয়েক দিন ধরেই পাড়ার তৃণমূল কর্মীরা বলে বেড়াচ্ছিল, সিপিএমের লোকেরা ভোট দিতে যেতে পারেন। কিন্তু, ইভিএমে বোতামটা ঘাসফুলেই টিপতে হবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী তো আর সব সময়ের জন্য থাকবে না! পরিবারের এক যুবকের কথায়, “তৃণমূলকে ভোট দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এই এলাকায় থাকতে গেলে ওদের চটানোও যাবে না। তাই ভোট না দেওয়াটাই ছিল সবচেয়ে ভাল উপায়।”

বুধবারের ভোটে এটাই বাস্তব বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত লাভপুর এবং নানুরে। সিপিএম কোথাও নেই। বীরভূমের এই দুই অঞ্চলে যে দিকে তাকানো যায়, সে দিকেই ঘাসফুল। ভোটের ছবিটা কিন্তু একই রকম থেকে গিয়েছে। ভোটারদের অভিযোগ, একটা সময়ে যে ভাবে এখানে ভোট করাত সিপিএম, এখন তৃণমূল সেই কায়দায় ভোট করাচ্ছে। কিছুদিন আগে এই কথাই তো বলেছিলেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর পরমার্শ ছিল, “সিপিএম ৩৪ বছর ধরে যে ভাবে শান্তিপূর্ণ ভোট করিয়েছে, আপনারাও সেই কায়দায় ভোট করুন।”

ঘটনা হল, সেই কায়দাতেই ভোট হয়েছে অনুব্রত মণ্ডল এবং তাঁর অনুগামী বিধায়ক মনিরুল ইসলামের খাসতালুক নানুর-লাভপুরে। সিপিএম সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলা হয়েছে, ভোট দেওয়ার দরকার নেই। ওটা পড়ে যাবে। কেউ কেউ সাহস করে ভোট দিতে বেরোলেও বুথের অনেকটা আগেই পথ আগলে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের বাহিনী। বুথে বুথে ভোটারদের ঘাড়ের কাছে কাছে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তৃণমূলের লোকজন, খোলা জানলা দিয়ে নজর রাখা হয়েছে ইভিএমে কোন চিহ্নে ছাপ পড়ছে, তার দিকে। বিরোধীদের এজেন্ট না থাকার সুযোগ নিয়ে শাসকদলের প্রার্থীর এজেন্টরাও বহু জায়গায় ভোটারদের প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ।

নির্বাচন কমিশনের প্রবল ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মিলেছে কম। বেলা লাভপুরের দাঁড়কা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে জনা দুই কেন্দ্রীয় সঙ্গে গল্পগুজব করছিলেন স্থানীয় চার জন যুবক। বুথে লাইন বিশেষ নেই। হাসিমুখে এক জওয়ান বললেন, ‘সব ঠিক হ্যায়।’ ওই চার যুবক নিজেদের পরিচয় দিলেন তৃণমূলের কর্মী হিসাবে। বুথে সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপিকোনও দলেরই এজেন্ট নেই। একমাত্র এজেন্ট তৃণমূলের। বেলা ১১টার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে গিয়েছে।

নানুরে পার্টি অফিসে বসে সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদক হাসিবুর রহমান বললেন, “এটাই তো স্বাভাবিক। তৃণমূল এ ভাবেই ভোট করিয়েছে নানুরে। ওদের সন্ত্রাসে ৭০-৭২টি বুথে আমরা এজেন্টই বসাতে পারিনি! ওই সব বুথে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা বিনা বাধায় ছাপ্পা ভোট মেরেছে।” স্থানীয় দাশকল গ্রামে দাঁড়িয়ে নানুরের তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করলেন, “সিপিএমের কাছে এখন এজেন্ট দেওয়ার মতো লোক নেই। তার জন্য আমরা কী করতে পারি! মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শান্তিতে ভোট দিতে পেরেছেন।”

চাপানউতোরটা খুবই চেনা। এক সময় তৃণমূলের অভিযোগ শুনে সিপিএম যা বলত, আজ তা-ই শোনা যাচ্ছে শাসক দলের নেতার মুখে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন