কত শ্রমিক ঘর ছাড়ছে, তথ্যই নেই

বরাবাজারের সন্দীপ মণ্ডল নামে এক যুবক ২০১৩ সালে পুজোর পরে সুরাটে রঙের কাজে গিয়েছিলেন। দু’সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই গ্রামে খবর এল, সুরাটে একটি বহুতল বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তিনি পড়ে মারা গিয়েছেন। তাঁর দেহ গ্রামেই ফিরল না। সেখানেই সত্‌কারের কাজ হয়েছিল। ২০১১ সালে চেন্নাইয়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন মানবাজার থানার মানপুর গ্রামের এক যুবক। গিয়ে থেকে আর তিনি কোনও খবর পাঠাননি।

Advertisement

সমীর দত্ত

মানবাজার শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:১৭
Share:

কাজের খোঁজে বাইরে পাড়ি।—ফাইল চিত্র।

বরাবাজারের সন্দীপ মণ্ডল নামে এক যুবক ২০১৩ সালে পুজোর পরে সুরাটে রঙের কাজে গিয়েছিলেন। দু’সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই গ্রামে খবর এল, সুরাটে একটি বহুতল বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তিনি পড়ে মারা গিয়েছেন। তাঁর দেহ গ্রামেই ফিরল না। সেখানেই সত্‌কারের কাজ হয়েছিল।

Advertisement

২০১১ সালে চেন্নাইয়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন মানবাজার থানার মানপুর গ্রামের এক যুবক। গিয়ে থেকে আর তিনি কোনও খবর পাঠাননি। তাঁর স্ত্রী থানায় অভিযোগ জানানোর পরে খোঁজ করে পুলিশ জানতে পারে, সেই ব্যক্তি চেন্নাইয়ে এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন। তাই তিনি বাড়ির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি।

মাসখানেক আগে মানবাজার ও বোরো থানা এলাকা থেকে ১৪ জন শ্রমিক রাজস্থানের জয়পুরে কাজে গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু শ্রমিক। সেখানে তাদের আটকে রেখে অমানুষিক অত্যাচার করিয়ে কাজ করানো হচ্ছিল। কিন্তু সে কথা বাড়ির লোক জানতে পারেননি। একজন কোনওরকমে গ্রামে ফিরে ঘটনাটি জানালেও, থানা-পুলিশ করতে দেরি হয়ে যায়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ফেরার পথে ট্রেনেই এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এরপরেই হইচই বাধে। পুলিশ ওই কারখানার মালিককে চাপ দিয়ে বাকিদের ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

Advertisement

জেলা থেকে ভিন্‌রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটে গেলেও ওই শ্রমিকদের নিয়ে কোনও তথ্যই নেই জেলা শ্রম দফতরের কাছে। পুরুলিয়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ নিয়ে ২০১২ সালে সমীক্ষা চালায়। তাদের দাবি, ফি বছর এই জেলা থেকে শ্রমিক হিসাবে ১৭-২১ হাজার মানুষ ভিন্‌ রাজ্যে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনাও বেশি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির অন্যতম কর্মকর্তা সাধু সিং সর্দার বলেন, “সব থেকে বিপজ্জনক দিক হল ইদানীং শিশু শ্রমিকদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ হল, এদের দিয়ে অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করানো যায়। আবার মজুরি নিয়েও প্রতিবাদ করে না। খাওয়াদাওয়া বাবদ খরচও কম।”

জেলায় সব ব্লকে শ্রম দফতরের অফিস রয়েছে। কিন্তু ব্লকে তো বটেই জেলাতেও কাজের সন্ধানে বাইরে যাওয়া শ্রমিকদের কোনও পরিসংখ্যান নেই। সেটা স্পষ্ট জেলার সহকারী শ্রম কমিশনার মনোজ সাহার কথাতেই। তিনি বলেন, “পুরুলিয়া জেলার ২০টি ব্লকে মাত্র ১১ জন আধিকারিক আছেন। এমনকী, কিছু অফিসে করণিকও নেই। শ্রমিকদের ভিন্‌রাজ্যে যাওয়ার তথ্য আমরা পাচ্ছি না। এ দিকে তথ্য সংগ্রহ করার মতো পরিকাঠামোও আমাদের নেই।”

শ্রম দফরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, ভিন্‌রাজ্যে শ্রমিক হিসাবে গেলে এজেন্সি মারফত্‌ শ্রম দফতরে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। কতজন, কোথায় যাচ্ছেন। তাঁদের পুরো ঠিকানা। সেই কর্মক্ষেত্রের বিশদ বিবরণ, কী ধরণের কাজ, মজুরির পরিমাণ, কতদিন থাকবেন পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জেলা শ্রম দফতরে জানাতে হয়। নথিভুক্ত শ্রমিক সেখানে কাজ করতে গিয়ে মারা গেলে বা আহত হলে তাঁর ক্ষতিপূরণ, চিকিত্‌সা খরচ সবই পাওয়া যায়। এ ছাড়াও স্থানীয় অথবা আইনগত সমস্যা দেখা দিলে শ্রম দফতরের তা মেটানো সম্ভব। মনোজবাবু বলেন, “এ অবধি কোনও এজেন্সি নাম নথিভুক্ত করায়নি। ফলে আমরাও জানতে পারি না কোন রাজ্যে কতজন গেলেন।”

মানবাজার ১ ব্লকের শ্রম আধিকারিক গৌতম বিশ্বাস বলেন, “একজন আধিকারিককে একাধিক ব্লকের দায়িত্বে কাজ করতে হচ্ছে। অথচ প্রতিটি ব্লক অফিসে আধিকারিক-সহ নূন্যতম তিনজনের থাকার কথা। করণিকের কাজও আমাকেই করতে হয়। এতে ভিন্‌রাজ্যে যাওয়া শ্রমিকদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা অসম্ভব।”

পুরুলিয়া থেকে কৃষি শ্রমিক হিসাবে বর্ধমান, হুগলিতে যাওয়া নতুন কথা নয়। ইদানীং আগের থেকে কৃষি শ্রমিক ভিন্‌ জেলায় যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সেই স্রোত বন্ধ হয়নি। শ্রম আধিকারিকদের মতে, এই সব কৃষি শ্রমিকরা রাজ্যের মধ্যে থাকায় সমস্যা হলে ভিন্‌ জেলার আধিকারিক অথবা রাজ্যস্তরের আধিকারিকের হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটানো যায়। কিন্তু যে সব শ্রমিকেরা ভিন্‌ রাজ্যে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন, তাঁদের পাশে অনেক ক্ষেত্রে সে ভাবে দাঁড়ানো যায় না। তা হলে শিবির করে প্রচার করছেন না কেন?

পুরুলিয়া জেলা শ্রম আধিকারিক মনোজ সাহার স্বীকারোক্তি, “শিবির করার মতো লোকবলও নেই। তবে এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি এগিয়ে এলে আমাদের দফতর অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করবে।”

হাল-হকিকত

ফি-বছর পুরুলিয়া থেকে শ্রমিক হিসাবে ১৭-২১ হাজার মানুষ ভিন্‌ রাজ্যে যানজানাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষা।

জেলায় সব ব্লকে শ্রম দফতরের অফিস আছে। কিন্তু ব্লকে তো বটেই, জেলা প্রশাসনের কাছেও কাজের সন্ধানে বাইরে যাওয়া শ্রমিকদের পরিসংখ্যান নেই।

ভিন্‌ রাজ্যে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে গেলে এজেন্সি মারফত শ্রম দফতরে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়।

ঠিকানা, কাজের ধরন, মজুরির পরিমাণ ইত্যাদি তথ্যও প্রশাসনকে জানানোর নিয়ম। কিন্তু, সরকারি স্তরে প্রচার ও সচেতনতার অভাবে এই সব বিষয়ে এখনও অন্ধকারে অধিকাংশ শ্রমিক।

জেলার ২০টি ব্লকে মাত্র ১১ জন আধিকারিক রয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন