কবিগান পাড়ি দিচ্ছে মুম্বইয়ে

‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির ভোলা ময়রা আর ফিরিঙ্গি সাহেবের জমাটি সেই তর্জার কথা বাঙালি আজও ভোলেনি। বিস্মৃত হয়নি কবিগানও। তাই তো পুজোর মুখে সাজোসাজো রব কবিয়ালদের। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ঢোল-কাঁসার তালে তালে ছান্দিক তর্ক। শিল্পীদের এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কেউ পাড়ি দেবেন সুদূর মুম্বই নগরী, কেউ বা বর্ধমান, হুগলি, নদিয়ায়।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৪
Share:

কবিয়াল সুব্রত সেনের কবিগানের মহড়া চলছে। ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির ভোলা ময়রা আর ফিরিঙ্গি সাহেবের জমাটি সেই তর্জার কথা বাঙালি আজও ভোলেনি। বিস্মৃত হয়নি কবিগানও। তাই তো পুজোর মুখে সাজোসাজো রব কবিয়ালদের। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ঢোল-কাঁসার তালে তালে ছান্দিক তর্ক। শিল্পীদের এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কেউ পাড়ি দেবেন সুদূর মুম্বই নগরী, কেউ বা বর্ধমান, হুগলি, নদিয়ায়। আবার অনেকেরই পুজোর ক’দিন টানা অনুষ্ঠান বাঁকুড়ার গাঁয়েগঞ্জে।

Advertisement

মুম্বইয়ের একাধিক পুজো কমিটিতে উদ্যোগে পুজোর দিনগুলিতে বসবে কবিগানের আসর। তারই একটিতে ডাক পেয়েছেন বাঁকুড়ার প্রবীণ কবিয়াল গঙ্গাজলঘাটির দুর্লভপুর লাগোয়া কলগড়ার বাসিন্দা শ্যামাপদ ভট্টাচার্য। পাল্লাদার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেরই শিষ্য গুণময় দাসকে। গুণময়বাবু আসানসোলের বাসিন্দা। শ্যামাপদবাবুর সঙ্গে একের পর এক আসরে গিয়েই তিনি কবিয়ালে দক্ষ হয়েছেন। এ বার সরাসরি গুরুর সঙ্গে লড়াইয়ে নামবেন। তা-ও আবার খাস বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ে!

শ্যামাপদবাবুর কথায়, “শিষ্য হলে কী হবে, প্রায় ৪০ বছর কবিয়ালগিরি করছে গুণময়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এখন অনেক পরিণত কবিয়াল হয়েছে সে।” ঠিক কোন বিষয়ে তর্জা বাঁধবে গুরু-শিষ্যের, তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। শ্যামাপদবাবু বলছেন, “কবিয়াল গানে তর্কের কোনও নির্দিষ্ট বিষয় থাকে না। দর্শকেরা যা চাইবেন, তা নিয়েই আমাদের তর্ক জুড়তে হবে।”

Advertisement

প্রবীণ ওই শিল্পী জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিয়াল গানের তর্কের বিষয় অনেক বদলে গিয়েছে। আগে মূলত পুরাণের নানা চরিত্র নিয়েই তর্জা বাঁধত। সেখানে শিব বড় না দুর্গা, শ্রীকৃষ্ণ-দুর্যোধন লড়াই, রাম-রাবণের শক্তি-র মতো বিষয় নিয়েই তর্ক পছন্দ করতেন মানুষ। কিন্তু, বর্তমান প্রজন্মের দর্শকেরা পৌরাণিকের চেয়ে বেশি রস খুঁজে পাচ্ছেন বিজ্ঞান বনাম ভগবান, চোর বনাম সাধু, নারী বনাম পুরুষ, দুধ বনাম মদের যুদ্ধে। পরিবর্তন এসেছে বাদ্যযন্ত্রেও। বহু কবিগানের দলই আসর মাতাতে সিন্থেসাইজার, অক্টোপ্যাড নিয়ে যাচ্ছেন। তবে, শ্যামাপদবাবু বলছেন, “এ দেশীয় কবিগানে ঢোল ও করতালের চল রয়ছে। পূর্ববঙ্গের কবিগানে অবশ্য নানা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করার চল ছিল প্রথম থেকেই। তবে, এখন এ দেশের কিছু কবিয়াল শিল্পীও ওই দেশের অনুকরণে বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ করছেন।” যদিও তিনি প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের ছক ভাঙতে নারাজ বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। পাল্লাদার গুণময়বাবু বলেন, “বাইরের দর্শকদের মন জয় করাটাই এখন আমাদের লক্ষ্য।”

এ বার পুজোয় ঠাসা অনুষ্ঠান বাঁকুড়া শহরের কবিয়াল সুব্রতকুমার সেনের। এমনিতে শহুরে কবিয়াল হিসেবে জেলায় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে রয়েছে। প্রায় দু’দশক ধরে তিনি কবিগানের আসর মাতাচ্ছেন। সুব্রতবাবু জানান, আগে কবিগানে যিনি জিততেন, তাঁকে গ্রামবাসীরা টাকার মালা পরাতেন। হারলে জোর করে খাওয়ানো হতো কলা। পরাজিত কবিয়ালের কপালে জুটত ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনা। তখন রাতভর চলত কবি-লড়াই। তাঁর আক্ষেপ, “এখন হার-জিত আর হয় না। মাঝপথেই পালা থামিয়ে দেওয়া হয়। পালাও রাতভর চলে না।” তবে, কবিগানের চাহিদা বাজারে কমেনি বলেই তাঁর মত। তাঁর কথায়, “সারা বছরই অনুষ্ঠান চলছে। শিল্পীদের রোজগারও বেড়েছে।”

পাত্রসায়রের ফকিরডাঙা এলাকার কবিয়াল বাবর আলি মিদ্যার এ বার পুজোয় বর্ধমানের একাধিক জায়গায় ডাক রয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে কবিয়াল গান করছেন বাবর সাহেব। তিনি জানান, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, হুগলির মতো জেলা থেকে প্রায়-ই তাঁর ডাক আসে তাঁর। পাত্রসায়র এলাকার কবিয়াল কালীপদ হাজরা, দিলীপ চক্রবর্তীরাও পুজোর বাজারে খুব ব্যস্ত। বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন মোবারকপুরের বাসিন্দা তপন নন্দী বলেন, “প্রতি বছর রাধা অষ্টমীতে আমাদের গ্রামে জমে ওঠে কবিয়াল লড়াই। সারা বছর ওই দিনটার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি।” নবি মুম্বইয়ের শানপাড়া বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন পুজো কমিটির সংস্কৃতি সম্পাদক অপূর্বকুমার মজুমদার মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের বাসিন্দা। মুম্বই থেকে ফোনে সেই সত্তরের দশকের ছেলেবেলার স্মৃতি আওড়ে তিনি বলেন, “সেই সময় পলিথিনে মুড়ি, বাতাসা নিয়ে ছুটতাম কবিগানের লড়াই দেখতে। রাতভর চলত জমজমাটি অনুষ্ঠান। আগামী প্রজন্মও যাতে এই গান শোনার সুযোগ পায়, তাই কবিগানের লড়াইয়ের আয়োজন করেছি।”

মুম্বইয়ের একাধিক পুজো কমিটিতে এই রাজ্য থেকে শিল্পীদের অনুষ্ঠানের জন্য নিয়ে যান কলকাতার বাসিন্দা গৌতম মিত্র। তিনি বলছেন, “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামে চলচ্ছিত্র ছাড়া মুম্বইয়ের বর্তমান প্রজন্মের বহু বাঙালিই কবিগানের লড়াই সম্পর্কে বিশেষ জানেন না। তবে, এ বার তাঁরা সামনা সামনি বাংলার এই বৈচিত্রময় প্রাচীন সংস্কৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ পাবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন