বাঁকুড়ার বৈঠকে। বৃহস্পতিবার। ছবি: অভিজিত্ সিংহ।
বিভিন্ন প্রকল্পের খোঁজখবর নিতে গিয়ে কখনও তিনি চোটে গেলেন, কখনও আবার হাল্কা মস্করাও করলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাঁকুড়ায় সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ ভাবেই পেলেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা ও জন প্রতিনিধিরা। তবে বৈঠকের সুর বেঁধে রাখলেন উন্নয়নের লক্ষ্যেই। শিল্পাঞ্চলে যাতে গোলমাল না হয়, সে ব্যাপারে বিধায়কদেরও সতর্ক করে দেন তিনি।
পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠক, হুড়ায় সভা করে বাঁকুড়ায় তিনি বৈঠক করেন। টানা এতখানি পথ ঘুরে দফায় বক্তব রাখার পরেও মমতাকে সন্ধ্যায় নিজস্ব মেজাজেই পাওয়া গেল বাঁকুড়ায়। প্রশাসন সূত্রে খবর, বৈঠকের শুরুতেই কন্যাশ্রী ও ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ নিয়ে মেজাজ হারান তিনি।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের রিপোর্ট দেখে তিনি মোটেই খুশি হননি। তাঁর একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বেগ পেতে হয় জেলাশাসক বিজয় ভারতী-সহ সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের। কন্যাশ্রী ১ (অষ্টম শ্রেণি থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত) ও কন্যাশ্রী ২ (১৮ বছরের ঊর্ধ্বে) প্রকল্পের জেলার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি সরকারি আধিকারিকদের কাছে জানতে চান, “কন্যাশ্রীর দুই প্রকল্পের হাল এত খারাপ কেন?” আধিকারিকরা জানান, ছাত্রীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। জবাব শুনে মুখ্যমন্ত্রী আরও চোটে যান। এরপরেই তিনি বলেন, “আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। যে যে স্কুলে কন্যাশ্রী প্রকল্পে পৌঁছতে পারেনি, সেই সব স্কুলে ও কলেজে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে।” তিনি জানান, ১৫ দিন পরে আমরা কন্যাশ্রী দিবস পালন করা হবে। তার আগে ও কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন তিনি।
প্রসঙ্গ ওঠে জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিত্সকের অভাব রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী একটি সমাধান সূত্রে অবশ্য বের করে দিয়েছেন। তাঁর দাওয়াই, গ্রামীণ এলাকায় যে সব ছেলেরা ডাক্তারি পাশ করেছেন, তাঁরা অনেকে নিজেদের এলাকায় কাজ করতে চান। তাঁদের চিহ্নিত করে সেই এলাকাতেই নিয়োগ করা যায়। তা হলে এই সমস্যা অনেকটাই কাটবে।
নিজ ভূমি ও নিজ গৃহ প্রকল্পে পাট্টা বিলির রির্পোট দেখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আপনারা বলছেন, এত বড় বাঁকুড়া জেলায় আর মাত্র কয়েকশো মানুষ জমিহীন রয়েছে! এটা কী করে সম্ভব? এই রির্পোট নিয়ে পুনরায় আপনারা আলোচনায় বসুন।” পাট্টা বিলি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের তির নিক্ষেপ হয় বিধায়কদের দিকে। তিনি বলেন, “জেলায় আমি যখনই আসি সাধারণ মানুষ আমার কাছে এসে বলেন, দিদি এটা আমরা পাইনি, ওটা আমরা পাইনি। আপনারা তাঁদের কাছে যেতে পারছেন না? নিজের এলাকায় ঘুরতে পারছেন না। মনে রাখবেন, কলকাতায় যাওয়ার থেকে নিজেদের এলাকায় ঘোরাটা বেশি জরুরি। ভাল পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়ালেই হবে না। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক আধিকারিকদের নির্দেশ দেন, শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরাঞ্চলের মানুষদেরও পাট্টা দিতে হবে। রাজনৈতিক মহলের মতে, আগামী বছর পুরভোটের কথা মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী শহরের দিকে বাড়তি নজর দিতে ওই নির্দেশ দিয়েছেন। এ দিন বৈঠকে তিনি বাঁকুড়ার পুরপ্রধান শম্পা দরিপার কাছে বাঁকুড়া শহরের জলের সমস্যা সম্পর্কে জানতে চান। শম্পা জানান, রাজ্যের দেওয়া ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকায় পাইপলাইন বসানো হয়েছে। কিন্তু আরও কিছু সমস্যায় কাজ আটকে রয়েছে। মমতা তাঁকে বিষয়টি লিখিত ভাবে জানাতে বলেন।
১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের টাকা কোনও অবস্থাতেই ফেলে রাখা যাবে না বলেও প্রশাসনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, “এই প্রকল্পে কাজ করার পরে শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন না, এমন অভিযোগ যেন আমাকে না শুনতে হয়।” জেলার কয়েক জন বিডিও-র কাছে তাঁদের এলাকায় ১০০ দিনের প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কেও খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঠিকমতো কাজ দেওয়া হচ্ছে না বলে তিনি সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “যদি কাজ না দিতে পারলাম তবে, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ তৈরি করে কাজ কী?” বড়জোড়ার বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে তিনি সতর্ক করে দেন, “শিল্পপতিদের কাছ থেকে যেন আমি যেন কোনও অভিযোগ না শুনি। এখানে অনেক কিছু হচ্ছে। সব কিছু খোঁজ নেওয়ার জন্য তোমাকে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে।” আশুতোষবাবু অবশ্য ওই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এলাকায় হাতির সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, দরকারে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে হাতি উপদ্রুত মানুষদের সাহায্য করতে হবে।
এর পরেই তিনি নজর দেন সভায় বসে থাকা সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহার দিকে। লোকসভা ভোটে একটি বুথে ভোটকর্মীদের মারধর করে দলবল নিয়ে ছাপ্পা ভোট করানো অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। মমতা বলেন, “তোমার কী সমস্যা আছে দীপালি?” তার পরেই মুচকি হেসে বলেন, “ও খুব ঝগড়ুটে। খুব ঝগড়া করে।” দীপালি জানান, শালি নদীর উপর সেতু গড়ার জন্য ১১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা এসে পড়ে রয়েছে। অথচ কাজ হচ্ছে না। বিষয়টি জেলাশাসককে দেখার নির্দেশ দেন মমতা। বিষ্ণুপুরের সাংসদ তথা রাজ্য যুব তৃণমূলের সভাপতি সৌমিত্র খাঁ বেলিয়াতোড়কে নতুন ব্লক ঘোষণার দাবি করেন, যদিও মমতা সঙ্গে সঙ্গে তা খারিজ করে দেন।