চার পীরের মাজার ঘিরে বেড়ে উঠেছে মাড়গ্রাম

মাড়গ্রাম নয়, ‘কাটা মাড়গ্রাম’! জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামের নামের ব্যাখ্যা শুনে চমকে উঠতেই হল। কেউ কেউ বলেন, শুধু জেলা নয়, পশ্চিমবঙ্গের মধ্য সব থেকে বড় গ্রাম মাড়গ্রাম। এলাকার মানুষ বলছেন, আজকের যে মাড়গ্রাম সেই জনপদ আগে ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। জঙ্গল কেটে জনবসতি গড়ে উঠেছে সেই জন্য নাম ছিল ‘কাটা মাড়গ্রাম’। কারও মতে, মুর্শিদাবাদ জেলায় মাড়গ্রাম নামে আর একটি গ্রাম আছে। সেই জন্য তফাৎ বোঝাতে বীরভূম জেলার মাড়গ্রামকে কাটা মাড়গ্রাম বলা হত।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

মাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

বুড়ো পীরতলার আস্তানা। মাড়গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

মাড়গ্রাম নয়, ‘কাটা মাড়গ্রাম’!

Advertisement

জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামের নামের ব্যাখ্যা শুনে চমকে উঠতেই হল। কেউ কেউ বলেন, শুধু জেলা নয়, পশ্চিমবঙ্গের মধ্য সব থেকে বড় গ্রাম মাড়গ্রাম। এলাকার মানুষ বলছেন, আজকের যে মাড়গ্রাম সেই জনপদ আগে ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। জঙ্গল কেটে জনবসতি গড়ে উঠেছে সেই জন্য নাম ছিল ‘কাটা মাড়গ্রাম’। কারও মতে, মুর্শিদাবাদ জেলায় মাড়গ্রাম নামে আর একটি গ্রাম আছে। সেই জন্য তফাৎ বোঝাতে বীরভূম জেলার মাড়গ্রামকে কাটা মাড়গ্রাম বলা হত।

ঘটনা হল, জঙ্গল কেটেই হোক আর অন্য ভাবেই হোক আজকের মাড়গ্রাম জনপদ অনেকটাই বিস্তৃত। তবে একান্ত কৃষি নির্ভর মাড়গ্রামের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসের সঙ্গে আজকের সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির ছবিটি সুপরিচিত। জনশ্রুতি মাড়গ্রামের দক্ষিণ দিকে দ্বারকা নদীর ধারে এক সময় মাণ্ডব্য নামে এক মুনির আশ্রম ছিল। সেই মুনির আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিডিও অফিসের পিছনে গ্রামের নদীর ধারে রয়েছে। দ্বারকা নদী পেরিয়ে এই আশ্রমেই বামাক্ষ্যাপা চলে আসতেন বলে লোকশ্রুতি। তারাপীঠে মা তারার দর্শন পেতে, বামার নদী পার হওয়া ঘিরে মাড়গ্রামে এখনও নানা অলৌকিক কাহিনি ঘোরে লোকের মুখে মুখে।

Advertisement

অনেকে মনে করেন সেই মাণ্ডব্য মুনির নাম থেকে মাড়গ্রামের নাম হয়ে থাকতে পারে। আজ থেকে ৮০ বছর আগে গৌরীহর মিত্রের লেখা ‘বীরভূমের ইতিহাস’ এবং ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ গেজেটিয়ারেও ‘মাড়গ্রাম’ নামের উৎস্য সন্ধানে মাণ্ডব্য মুনির নাম অনুসারে মাড়গ্রাম নাম হতে পারে বলে উল্লেখ আছে। বীরভূম গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে, মাড়গ্রামে এক সময় শাহ গরিব উল্লাহ বিয়াভম, শাহ মাদার, শাহ করমউদ্দিন এবং জাফর খান গাজি এই চার পীরের সহাবস্থান ঘটেছিল। যার নির্দশন স্বরপ গ্রাম ঢুকতে পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ফকির সাহেবের পীরের মাজার। এটি ‘ফকির বাগান’ নামেও এখন পরিচিত। গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে মাদার শরিফ তলা। উত্তর প্রান্তে আছে করমজি তলা। আর গ্রামের মাঝখানে জাফর খাঁ গাজীর পীরতলা। যা মাড়গ্রামে বুড়ো পীরতলা বলে খ্যাত।

এটিও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের নিকট পবিত্র স্থান বলে পরিচিত। এই মাজারের সীমানার মধ্যেই বহু দিন ধরে একটি শিবলিঙ্গ আছে। এই সুবাদে সকল ধর্মের মানুষ তাঁদের মনস্কামনা নিবেদন করেন। প্রতি বছর ১১ পৌষ থেকে সাত দিনের মেলা বসে এখানে। আবার করমজী তলা, মাদার শরিফ তলা, ফকির বাগান এলাকায় বসন্ত কালে ও গ্রীষ্মকালে মেলা বসে। গ্রামের আপামর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় মানুষ এই সমস্ত মেলায় সম্প্রীতি বজায় রেখে মেলায় যোগ দেন।

কেউ কেউ আবার মনে করেন গ্রামে মাণ্ডব্য নামে এক জাতি ছিল। সেই জাতির নামে মাড়গ্রাম নাম হতে পারে। তবে, গ্রামে হাতিবাঁধা মোড় থেকে বাজারের দিকে যাওয়ার পথে এখনও ‘মাণ্ডব্যতলা’ আছে। সেখানে সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো হয়। গ্রামের শেষপ্রান্তে পূর্ব দিকে রয়েছে ‘ইনতলা’ বাসস্টপেজ। মাড়গ্রাম হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, শেখপাড়ার বাসিন্দা মারফত সেখ বলেন, “গ্রামের পূর্ব দিকে ইন্দ্রসাগর পুকুর পাড়ে আগে ইন্দ্র দেবতার পুজো হত। সেই জন্য এলাকার নাম ছিল ইন্দ্রতলা। যা অপভ্রংশে নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ইনতলা।’’ জানা গেল, এলাকায় হাতিবাঁধার মোড়, ধূলফেলার মোড়, নবাব আমলের দেওয়ান চাঁদের বাড়িও রয়েছে।

বীরভূমের প্রাক্তন জেলাশাসক বরুণ রায় সম্পাদিত ‘বীরভূমি বীরভূম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, লেখক আব্দুল মান্নাফ মাড়গ্রাম সম্বন্ধে লিখেছেন, ওই গ্রামের আগে নাম ছিল মানগাঁও। আবার ‘বীরভূম সাহিত্য পরিষদে’র সভাপতি কিশোরীরঞ্জন দাস মাড়গ্রাম সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, মাড়গ্রামে হিন্দু রাজা মানপতি সিং নামে একজন হিন্দু রাজার মাণ্ডবনগর নামে একটি নগর ছিল। গৌরীহর মিত্রের লেখা ‘বীরভূমের ইতিহাস’-বইতেও উল্লেখ রয়েছে আজ থেকে ৭০০ বছর আগে মাড়গ্রামে মানপতি সিং নামে এক হিন্দু রাজা ছিলেন।

সরকারি গেজিটিয়ার উল্লেখ আছে, মানপতি সিং মাণ্ডব্য মুনির আশ্রম লাগোয়া একটি নগর গড়ে তোলেন। যার নাম ছিল মাণ্ডবনগর। কথিত আছে, জাফর খান গাজি ওরফে মহম্মদ হোসেন সেই মাণ্ডবনগরে এসেছিলেন। এবং যুদ্ধে মানপতি সিং-কে পরাজিত করেছিলেন। এর পরেই মাণ্ডবনগর দখল করেন জাফর গাজি খান। পরে এই জাফর গাজি একটি যুদ্ধে রাজা বিনোদের কাছে হেরে যান। মাড়গ্রামেই জাফর গাজির দেহ সমাধিস্থ করা হয়।

মাড়গ্রাম নিয়ে যা-ই জনশ্রুতি যাই থাকুক, ইতিহাসের নানা গল্পে গাঁথা এই শহরে উন্নয়নের ছোঁওয়া লেগেছে বহু পরে। রামপুরহাটে রেল লাইন চালু হওয়ার আগে কৃষিনির্ভর মাড়গ্রাম এক সময় বসোয়া, বিষ্ণুপুর এবং লাগোয়া মুর্শিদাবাদ জেলার রেশমচাষিদের কেনাবেচার বাজার ছিল। সে সময় রামপুরহাট থেকে মাড়গ্রাম হয়ে বিষ্ণুপুর যাওয়ার রাস্তা ছিল দুর্গম। মাড়গ্রাম হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, বর্তমানে রামপুরহাটের বাসিন্দা মৌলানা আবদুর রশিদ সরকার বলেন, “রামপুরহাট থেকে মাড়গ্রামের রাস্তা আগে মেঠো পথ ছিল। পিচ রাস্তা হয়ে এখন তা আমুলে পাল্টে গিয়েছে।” ১৯৬১-’৬২ সালে মাড়গ্রাম-বিষ্ণুপুর রাস্তা তৈরি হয়। ’৯০ সালে সেই রাস্তা বিজ্ঞানী কুদরত-এ-খুদার স্মরণে নামাঙ্কৃত হয়। একই সময়ে মাড়গ্রামে ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর বসত বাড়িতে তৈরি হয় ‘বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র’।

ধীরে ধীরে মাড়গ্রামের আধুনিক দিকে পথ চলা শুরু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন