জৌলুস নেই, তবু স্মৃতিতে মাতে মুখোপাধ্যায় পরিবার

স্মৃতি থেকে বলছিলেন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ। “খোস কদমপুরের পালমশাই বলেছিলেন, ‘এই শেষ। শেষ বারের মতো প্রতিমা গড়ে দিয়ে যাচ্ছি। পরের বার কষ্ট করে আসব না বাপু এ্যাদ্দূর!’ সেটা ১৩৪১ সাল হবে।” বলতে বলতেই উদাস চোখ। অদূরে প্রতিমার চালচিত্তির আঁকছেন বড়া গ্রাম থেকে আসা শিল্পী মাণিক। “পালমশাই নিঃসন্তান ছিলেন কি না। বলেছিলেন, ‘যা আছে খাবার কেউ নেই। কার জন্য করব? এখনও যে নিঃসন্তান!’ বাবা-ঠাকুর্দার বলা কথাগুলো কানে বাজে এখনও! পুজো এলেই মনে পড়ে!”

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

বোলপুর শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৭
Share:

চার দিনে চার শরিক পুজো পালা করে পুজো করেন আদিত্যপুর মুখোপাধ্যায় পরিবার। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

স্মৃতি থেকে বলছিলেন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ। “খোস কদমপুরের পালমশাই বলেছিলেন, ‘এই শেষ। শেষ বারের মতো প্রতিমা গড়ে দিয়ে যাচ্ছি। পরের বার কষ্ট করে আসব না বাপু এ্যাদ্দূর!’ সেটা ১৩৪১ সাল হবে।”

Advertisement

বলতে বলতেই উদাস চোখ। অদূরে প্রতিমার চালচিত্তির আঁকছেন বড়া গ্রাম থেকে আসা শিল্পী মাণিক।

“পালমশাই নিঃসন্তান ছিলেন কি না। বলেছিলেন, ‘যা আছে খাবার কেউ নেই। কার জন্য করব? এখনও যে নিঃসন্তান!’ বাবা-ঠাকুর্দার বলা কথাগুলো কানে বাজে এখনও! পুজো এলেই মনে পড়ে!”

Advertisement

কার্তিকতলায় দাওয়ায় বসে, ফেলে আসা দিনের কথা বলছিলেন আদিত্যপুর মুখোপাধ্যায় পরিবারের মধুসূদনবাবু। তাঁর স্মৃতিচারিতার মাঝেই এসে দাঁড়ালেন মেজদা, বিশ্বভারতীর মুদ্রণ বিভাগের কর্মী সুশীল মুখোপাধ্যায়। দুই ভাইয়ের পারস্পরিক স্মৃতিকথনে জানা গেল, দুর্গার বরে পালমশাইয়ের সন্তান প্রাপ্তির গল্প।

বোলপুর লাগোয়া শক্তিপীঠ কঙ্কালিতলার ঠিক পাশের গ্রাম আদিত্যপুরের এই পরিবারের পুজো ঘিরে রয়েছে এমনই নানা কথকতা। সে সবেরই স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন এক একজন শরিক।

কথার পরতে পরতে ভিড় করছিল গ্রামের নানা মুখ। পুজোতলায় তাঁদের সানন্দ উপস্থিতি জানান দিল ‘মুখুজ্জে’ পরিবারের পুজো হলেও, এ পুজো আদতে গোটা গ্রামের। এলাকার অন্য গ্রামের বাসিন্দারাও যোগদেন পুজোয়। সত্যি বোঝা দায়, এ কোনও পরিবারের ঘরোয়া পুজো! পারিবারিক পুজো সর্বজনীন হয় বুঝি এভাবেও।

কথিত রয়েছে, মুখোপাধ্যায় পরিবারে এখন যেখানে দেবী মূর্তি সেখানে আগে ছিল পঞ্চমুণ্ডির আসন। প্রাচীন রীতি এই স্থানটিতেই পুরুষানুক্রমিক পুজো করে করেছেন আদি শরিক প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়, শঙ্করনাথ মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায় এবং দৌহিত্র সূত্রে কমলিনী ভট্টাচার্য ও তাঁর স্বামী অমূল্য রতন ভট্টাচার্য।

এক চালার সাবেকি প্রতিমা এবং শতাব্দী প্রাচীন দোলার দিকে তাকিয়ে পুজোর নানা উপচার নিয়ে বলছিলেন শরিকরা। প্রথা মেনেই এই পরিবারে সপ্তমীতে কোপাই নদীতে ‘নবপত্রিকা’ আবাহন, দেবীর চক্ষু দান এবং মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে ‘মহাপ্রদীপ’ প্রজ্বলন করা হয়। মহাভোগের নৈবেদ্যও হয় রীতি মেনেই। রয়েছে বলিদান প্রথাও। দেবী দুর্গার পুজোর সঙ্গে মহানবমীতে কুমারী পুজার রীতিও প্রচলিত এখানে। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত চার শরিক এক এক দিন করে, পুজো নানা বিষয় ভাগ করে নেন। তবে, বিসর্জন হয় ফের সম্মিলিত উদ্যোগেই।

“একবারের কথা জানেন!” বলছিলেন এক শরিক। ১৯৭২- ৭৩ সালে এক শরিক আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে পুজো না করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এত প্রাচীন-পারিবারিক পুজো বন্ধ হয়ে যাবে? চিন্তায় পড়েন সকলে। সুশীলবাবুর কথায়, “এমন দোলাচলের সময় বাবা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান। দুই ভাই আট কিমি দুরের শ্রীনিধিপুর থেকে মাথায় ঝুড়ি করে মায়ের মুখ এনেছিলাম, পায়ে হেঁটে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের মুখ এল।”

দেবী-মাহাত্ম্যর কথায় তাঁর অভিজ্ঞতা, “কোনও বায়না ছাড়া, চতুর্থীর দিন ডাকের সাজ যিনি করেন, মাকে সাজিয়ে দিয়ে গেলেন। কোথা থেকে কি এল আর কেমন করে ফের পুজো হল, সত্যি আজও বিস্ময়ের!”

পুজো উপলক্ষে আর পাঁচটা পরিবারের মতো এই পরিবারেও একসময় নাটকের চল ছিল। ‘সুশীল নাট্য কোম্পানি’-র কথা এখনও চর্চিত। “পুজো চার দিন এক সময় চার-চারটে নাটক হত। কাঠের তক্তা-চেয়ার দিয়ে মঞ্চসজ্জা, নাটকের রিহার্সাল, বাড়ির মহিলাদের শাড়ি দিয়ে স্ক্রিন। সে এক দিন ছিল।” বলছিলেন এক শরিক।

পুজো আছে, কিন্তু সেই জাঁক নেই। হারিয়ে গিয়েছে পুজোর নাটকের সংলাপগুলোও। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে গল্প-কথায় থেকে যাওয়া সে সবই এখন টুকরো টুকরো স্মৃতির ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন