প্রতিবন্ধকতা উড়িয়ে প্রাপ্তি পুরস্কার। বাড়ির দাওয়ায় অক্ষয়।—নিজস্ব চিত্র।
তিনি সুধা চন্দ্রণকে চেনেন না। চেনার কথাও নয়।
পুরুলিয়ার কেন্দা থানার প্রত্যন্ত গ্রাম হরিহরপুর গ্রামের অক্ষয় সহিস একজন সামান্য ছৌ শিল্পী। কিন্তু তিনি অসামান্য কাজ করে যাচ্ছেন।
সুধার সঙ্গে মিল অবশ্য কম নয় অক্ষয়ের। গাড়ি দুর্ঘটনায় পা হারানো সুধার জেদের কাছে হার মেনেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। জয়পুরি নকল পায়ের সাহায্যে নেচে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর ভিন্ ক্লাবের হয়ে ২০ টাকা ভাড়া আর পেট পুরে মাংস ভাত পাওয়ার জন্য ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে ১৫ বছর বয়সে ডান পায়ে চোট পান অক্ষয়। বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। স্থানীয় ভাবে তাঁর চিকিত্সা হয়। কয়েকদিনের মধ্যে পা ফুলে ঢোল। সেই সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিত্সকেরা জানিয়েছিলেন, পা কাটতেই হবে। তা ছাড়া উপায় নেই। পায়ের বিনিময়ে জীবন রক্ষা পেল অক্ষয়ের জীবন।
কেন্দা থানা থেকে চার কিলোমিটার ধুধু কাঁকড় বেছানো পথ উজিয়ে হরিহরপুর গ্রাম। গ্রামের একপ্রান্তে মাটির দেওয়াল আর টালির ছাউনির অক্ষয়দের বাড়ি। একপাশে ছৌদলের বিজ্ঞাপনের বোর্ড। অক্ষয়ের দিদি পুঙ্গলা বলেন, “গ্রামে ছৌ নাচের একটা দল ছিল। অক্ষয় ছেলেবেলা থেকেই দলে নর্তকী দুর্গা, কিরাত সাজত। সবাই বলত, ওর পায়ে ছন্দ রয়েছে। ফুটবল খেলাতেও ওর সুনাম ছিল। খেলতে গিয়েই তো পা-টা হারাল।” আনমনা হয়ে পড়েন পুঙ্গলা। বছর পনেরোর ভাগ্নি মামণি সহিস জানায়, তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচার ছবি এনে দেখায়।
দিদি পুঙ্গলার সঙ্গে অক্ষয় মাকে নিয়ে থাকেন। অক্ষয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু লাগোয়া গ্রাম ধরমপুরের বাসিন্দা উত্তম সিং। উত্তম বলেন, “অক্ষয় যে দিন পায়ে চোট পেয়ে মাঠে পড়েছিল, সে দিন আমরা কয়েক জন বন্ধু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই। তখন ওর খুব কঠিন সময় গিয়েছে। পরে আমরা গ্রামের কয়েক জন মিলে ছৌ দল গড়ি। জয়পুরি পা নিয়েই অক্ষয় এখন লম্ফঝম্প করে দর্শকদের কাছে বীররসের এই নাচ প্রদর্শন করে যাচ্ছে।” তাঁদের কাছে জানা যায়, পা বাদ যাওয়ার পরে অক্ষয় মনমরা হয়ে বাড়িতেই বসে থাকতেন। শুধুই হা-হুতাশ করতেন, তাঁর সব শেষ হয়ে গেল। একদিন কেন্দা বাজারে উত্তম একটা প্রচারপত্র কুড়িয়ে পান। তাতে লেখা ছিল, ঝাড়গ্রামে একটি সংস্থা প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে সরঞ্জাম দেবে।
ঝাড়গ্রামের শিবির থেকে তাঁকে জয়পুরি পায়ের ব্যবস্থা করা হয়। অক্ষয় বলেন, “প্রথম দিকে জয়পুরি পা নিয়ে অল্পস্বল্প হাঁটাহাঁটি শুরু করি। একটু ভরসা পেতেই ভাবলাম এই পায়ের সাহায্যে কি নাচা একেবারেই অসম্ভব? বাড়ির লোকজন, বন্ধুরা তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল খবরদার এক পা নিয়ে নাচতে যাস না। পা মুচড়ে পড়ে থাকবি। ওদের অজান্তেই আড়ালে একটু একটু করে নাচের অনুশীলন শুরু করি। প্রথম দিকে পায়ে খুব ব্যথা হতো। ব্যথা চেপে ধীরে ধীরে নাচের মুদ্রাগুলি ফের রপ্ত করতে শুরু করলাম। বন্ধুদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য একদিন নেচেও দেখিয়ে দিলাম।” অক্ষয়ের জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের সেই শুরু।
পুঙ্গলাদেবী বলেন, “ভাই যে আবার আসরে নাচতে পারবে স্বপ্নেও ভাবিনি। এই পা নিয়ে ও একশো দিনের কাজে মাটিও কাটছে।” অক্ষয়ের কথা শুনেছেন পুঞ্চার বিডিও সুপ্রতীক সিংহ। তার কথায়, “উনি জয়পুরি পা নিয়ে নাচেন বলে শুনেছি। অক্ষয়বাবু যাতে লোকশিল্পী হিসাবে সাহায্য পান তার ব্যবস্থা করব।”