দুগ্ধ ব্যবসায় দিশা দেখাচ্ছেন বিধান

প্রাকৃতিক গো-খাদ্যের অভাবে, তুলনামূলকভাবে গরু পালন কমছে বীরভূমে। জেলায় কমছে দুধের জোগানও। জেলার সরকারি দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় সঙ্ঘকে তাই দুধের জোগান ঠিক রাখতে নির্ভর করতে হচ্ছে পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের উপর। এ হেন পরিস্থিতিতেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুগ্ধ উৎপাদনকেই বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছেন বোলপুরের মির্জাপুর গ্রামের একটি পরিবার।

Advertisement

অরুণ মুখোপাধ্যায়

বোলপুর শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:২৬
Share:

নিজের গোয়ালঘরে বিধান সিংহ।

প্রাকৃতিক গো-খাদ্যের অভাবে, তুলনামূলকভাবে গরু পালন কমছে বীরভূমে। জেলায় কমছে দুধের জোগানও।

Advertisement

জেলার সরকারি দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় সঙ্ঘকে তাই দুধের জোগান ঠিক রাখতে নির্ভর করতে হচ্ছে পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের উপর। এ হেন পরিস্থিতিতেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুগ্ধ উৎপাদনকেই বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছেন বোলপুরের মির্জাপুর গ্রামের একটি পরিবার। উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, জেলার ভেটেনারি অফিসার তাপস কান্তি দাস। তাঁর কথায়, “এমন উদ্যোগ দেখে অনেকেই এগিয়ে আসতে পারেন। মির্জাপুরের বিধান সিংহদের এই উদ্যোগ একটি সফল উদ্যোগ।”

জেলা প্রাণি সম্পদ বিকাশ দফতরের দেওয়া পরিসংখ্যন বলছে, বীরভূমে দিন দিন কমে যাচ্ছে গরু পালন। গরুর প্রাকৃতিক খাবারের টান পড়েছে বলেই এমন পরিস্থিতি বলছেন তাঁরা। ফলে কৃত্রিম খাবার দিয়ে দুধ উৎপাদনকারী গাই গরু পালন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে সমস্যায় পড়েছেন জেলার সরকারি দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় সঙ্ঘও।

Advertisement

১৯৯৫ সালে, জেলার সদর শহর সিউড়িতে ময়ুরাক্ষী দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় সঙ্ঘ লিমিটেড তৈরি হয়েছিল। পরে সেটি ২০০১ সালে সরে আসে বোলপুরের সিয়ান এলাকায়। সংস্থার ম্যানেজিং ইনচার্জ উত্তম জানা বলেন, “জেলায় চাষ কমে আসছে। এতে গো-চারণ ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় দুধের যোগানও কমে যাচ্ছে। আগে লাভপুর থেকে দুধ আসত। এখন সাঁইথিয়া এলাকা থেকে দুধ নিয়ে আসেন অনেকে। বেশির ভাগ দুধই আসে মুর্শিদাবাদ থেকে।”

জানা গেল, এই সমবায় সঙ্ঘ সরকারি দরে দুধ কেনায়, অনেকেই আগ্রহ হারান। সে তুলনায় তাঁরা বাজারে দুধ বিক্রি করেন অনেক বেশি দামে। মির্জাপুর গ্রামের বিধান সিংহর পরিবারটিও এখন আর এখানে দুধ বিক্রি করেন না। তাঁরা কৃত্রিম খাবার অর্থাৎ গম, চাল, ফডার (এক ধরনের চাষ করা ঘাষ)ও খরের ভূষি দিয়ে তৈরি করা সরবৎ খাইয়ে ৬৪টি গরু বাঁচিয়ে রেখেছেন। কার্যত তাঁদের এই উদ্যোগকেই সাধুবাদ জানাচ্ছে জেলা প্রাণি সম্পদ বিকাশ দফতর।

বিধানবাবুদের ১৭টি গরু থেকে প্রতিদিন ১৩০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। সেই দুধের কিছুটা নিজেদের খাবার জন্য রেখে বাকি সব দুধই বিক্রি করে দেন। বোলপুর এলাকার ১২০টি বাড়িতে এবং কয়েকটি চা ও মিষ্টির দোকানে যায় দুধ। এ ছাড়াও মাসে ৬০০ সিএফটি গোবরও বিক্রি করেন তিনি। বিধানবাবু বলেন, “১০০ সিএফটি গোবর বিক্রি হয় ১২০০ টাকায়। দুধ ও গোবর বিক্রি করে যা পাওয়া যায় তা থেকে ৬৪টি গরুর খাবার, প্রতিষেধক ও ৬ জন শ্রমিকের বেতন বাদ দিয়ে মাসে প্রায় ২৬ হাজার টাকা আয় হয়। সব গরুই শঙ্কর জাতের।”

জেলায় কৃত্রিম প্রজননের প্রশিক্ষণ দেয় প্রাণি সম্পদ বিকাশ দফতর। সেই প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকে শুরু করলেও ব্যবসাভিত্তিক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। তবে বিধানবাবুর পরিবারে, তাঁর ভাই এই প্রশিক্ষণটি নিয়েছিলেন। জেলার নলহাটি ১ ব্লকের বাহাদুরপুর গ্রামে বেশ কয়েকজনও ব্যতিক্রম। ঘটনা হল, তাঁরা দুধ না বিক্রি করে, ছানা বিক্রি করেন অন্য জেলায়।

বিক্রির জন্য বোতলে ভরা হচ্ছে দুধ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

বিধানবাবু জানান, তাঁর বাবা ছিলেন বিশ্বভারতীর ইন্টারন্যাল অডিট অফিসার। প্রায় ৩৮ বছর আগে অবসর নেওয়ার পর পেনশন পেতেন মাসে ১২৫ টাকা। তখন তাঁর চার ভাই বেকার। ফলে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। তিনি বলেন, “সেই সময় থেকে বাবার পরামর্শে গাই গরু পালন করতে শুরু করি। তাতে দুধ উৎপাদন করে কোনও রকমে সংসার টিকিয়ে রেখেছিলাম। পরে একটা শঙ্কর জাতের গরু পালন করে, কৃত্রিম প্রজন্মের মাধ্যমে ২০টি শঙ্কর জাতের গরু পাওয়া গিয়েছিল।”

কীভাবে এই ব্যবসা ভিত্তিক উদ্যোগ নিলেন? বিধানবাবুর প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, ৬ জন কর্মী ছাড়াও তাঁর পরিবারে সকলেই গরুর পরিচর্যা করেন। এক ভাই বিপ্লববাবু দু’বেলা দুধ নিয়ে বোলপুরের নানা বাড়ি ও নির্দিষ্ট দোকানে বিক্রি করেন। বিধানবাবুরা এখনও মাটির বাড়িতে বসবাস করলেও, গরু থাকে পাকা বাড়িতে। গরুর জন্য গ্রীষ্ম কালে পাখা ও শীত কালে ঢাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

বিধানবাবুদের গরু পালন সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত বলে জানিয়েছেন বোলপুর শ্রীনিকেতন ব্লকের প্রাণি সম্পদ দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক গড়ীন্দ্র গড়াই। তিনি বলেন, “বিধানবাবুর ভাই বিপ্লববাবু আমাদের কাছে কৃত্রিম প্রজনন, প্রতিষেধক ব্যবহার-সহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের উদ্যোগ সফল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন