চারপাশে তৃণমূলের ঘাসফুল। তবু তৃণমূলের শক্তঘাঁটি ইঁদপুর শুক্রবার দেখল বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। আর সেই ভিড়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যতটা শাসকদলের বিরুদ্ধে গর্জন করলেন, ততটাই শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা শোনা গেল সভায় আসা মানুষজনের মধ্যে।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজেদের একসময়ে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক বলে দাবি করলেন। কারও গলায় আক্ষেপ, সারদায় টাকা খোয়ানোর। কারও প্রশ্ন এলাকার অনুন্নয়ন নিয়ে। কারও গলায় নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ।
এই ব্লকের সাতটির মধ্যে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় এখন তৃণমূল। জেলা পরিষদের দু’টি আসনেই জয় পায় জোড়া ফুলের প্রার্থীরা। জিতে নেয় পঞ্চায়েত সমিতিও। এহেন জনসর্থন পাওয়ার পরে তৃণমূল এই ব্লকে যে আরও জাঁকিয়ে বসবে সে বিষয়ে দ্বিমত ছিল না রাজনৈতিক মহলে। তবে শুক্রবার ইঁদপুর মোড়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সভার ভিড় দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠছে। পুলিশের হিসেবেই কম করেও হাজার দুয়েক মানুষ ভিড় করেছিলেন। যা এই ব্লকের পক্ষে খারাপ নয় বলে মনে করছেন তৃণমূলেরই একাংশ। আর রাহুলবাবু নিজে মঞ্চে উঠে বললেন, “এখানে তো পথসভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সভা কার্যত জনসভার রূপ নিয়েছে।” সভায় রাহুলবাবু তাঁর বক্তব্যে যখনই রাজ্য সরকারকে কটাক্ষ করেছেন, মঞ্চের সামনে উপস্থিত জনতার মধ্যে উছ্বাসের ঢেউ দেখা গিয়েছে। এই ভিড়ে আদিবাসী থেকে সংখ্যালঘু সকলেই উপস্থিত ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কেন বিজেপির সভায় তাঁরা? মঞ্চের উল্টো দিকে একটি বন্ধ দোকানের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ইঁদপুরের পায়রাচালির বাসিন্দা দিলীপ বাগদি বলেন, “সারদায় আমি ৩০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। কিন্তু সেই টাকা পেলাম না। তৃণমূলের নেতারাই সারদার হাত ঘুরে আমাদের টাকা নিয়েছেন বলে এখন দেখছি। গ্রামেরও অনেকে প্রতারিত। এই ক্ষোভ থেকেই আমরা অনেকে বিজেপিকে সমর্থন করছি।”
আবার সভার ভিড়ে উপস্থিত হাটগ্রামের সেখ সামসুর, সেখ আখতার, সেখ জফফরা জানালেন, বিধানসভা ভোটের আগে গ্রামের চাষ জমিতে সেচ ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন শাসকদলের নেতারা। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও একই আশ্বাস দিয়ে তাঁরা সমর্থন আদায় করেছিলেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, “ভোটের আগের ও সব প্রতিশ্রুতি পালন করেননি নেতারা। এ ছাড়াও গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে প্রাথমিক স্কুল হওয়ায় ছেলে মেয়েদের যাতায়াত করতেও অসুবিধা হচ্ছে। তাই গ্রামেই স্কুল গড়ার দাবি দীর্ঘ দিন ধরে জানিয়ে আসছি। কিন্তু সেই দাবিও পূরণ হয়নি।” তাঁদের ক্ষোভ, কোনও উন্নয়ন হয়নি। সব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিল। সরকারি প্রকল্পের কোনও সুফল গ্রামে দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা বলেন, “আমরাই বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূলকে এনেছিলাম। এখন আমরাই এই দলের পতন চাই।” সামসুর, আখতাররা যখন এই কথা বলছেন, রাহুলবাবু তখন মঞ্চে বলছেন, “ইমাম ভাতা চালু করার সময় রাজ্য সরকারকে প্রশ্ন করেছিলাম এতে গরিব মুসলিমদের কী লাভ হবে? আদপে ভোট ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না মুখ্যমন্ত্রী।” রাহুলবাবুর এই কটাক্ষ শুনে হাততালি দিয়ে উঠলেন আখতাররা। আদিবাসীদেরও এই সভায় বেশ যথেষ্ট সংখ্যায় দেখা গিয়েছে।
বিজেপির ইঁদপুর মণ্ডল সম্পাদক প্রতাপ পাণ্ডার দাবি, “ব্লকের অনেক গ্রামেই বিজেপির সমর্থক এখন তৃণমূলের চেয়ে বেশি। বিজেপিতে যোগ দিতে কাউকে বলতে হচ্ছে না। সকলেই নিজে থেকে এগিয়ে আসছেন।” বিজেপি ব্লক সভাপতি লক্ষণ মণ্ডল জানান, “মানুষ সিপিএমকে দেখেছে, তৃণমূলকে দেখেছে, এবার বিজেপিকে দেখতে চায়। নিজের বক্তব্যে এ দিন সারদা-কাণ্ড থেকে ধর্ষণ, সিভিক পুলিশদের দুর্দশা থেকে রাজ্যে শিল্পের দুরাবস্থা সব প্রসঙ্গই তুলে এনেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাহুলবাবু যখন বললেন, “আগামী বিধানসভা ভোটে জিতে আমরা এই রাজ্যকে সারা দেশের মধ্যে এক নম্বর রাজ্য বানাতে চাই, তখন দর্শকদের উছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। হাজারো মানুষের করতালিতে গমগম করে ওঠে চৌমাথা মোড়।
যদিও তৃণমূলের জনপ্রিয়তা এই ব্লকে কমছে বলে মানতে নারাজ ইঁদপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রহ্লাদ বাউরি। দলের নীচু তলায় দুর্নীতি হচ্ছে বলেও মানতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, “বিজেপি কোনও দিনই এই রাজ্যে দাঁড়াতে পারবে না। যাঁরা বলছেন উন্নয়ন হচ্ছে না, তাঁরা মিথ্যা কথা বলছেন। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থের কথা ভেবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাতে আমাদের দলের কিছু যায় আসে না। মানুষ আজও তৃণমূলের উপরই ভরসা রাখেন।”