দুর্গা আবাহনের পরেই অভিযান মদের ভাটিতে

তাঁরা সাত দিন সময় দিয়েছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। তাই পূর্ব নির্ধারিত শপথ মেনে একজোট হয়ে মদের ভাটি ভেঙে ফেললেন গ্রামের মহিলারাই। তার আগে বোধনের ঘট ভরে মা দুর্গার আবাহনও করলেন। বুধবার নলহাটির সিমলান্দি গ্রামের ঘটনা। এ দিন সকালে গ্রামের শতাধিক মহিলা দলবেঁধে ১০-১২টি মদের ভাটি ভাঙলেন। সেই সঙ্গে পরবর্তীতে গ্রামের আরও যে সমস্ত অবৈধ মদের ভাটি আছে সেগুলিও উচ্ছেদ করার অভিযানে নামার জন্য শপথ নিলেন।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

নলহাটি শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪০
Share:

মদ তৈরির সরঞ্জাম ভাঙছেন মহিলারা। সিমলান্দি গ্রামে বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

তাঁরা সাত দিন সময় দিয়েছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। তাই পূর্ব নির্ধারিত শপথ মেনে একজোট হয়ে মদের ভাটি ভেঙে ফেললেন গ্রামের মহিলারাই। তার আগে বোধনের ঘট ভরে মা দুর্গার আবাহনও করলেন। বুধবার নলহাটির সিমলান্দি গ্রামের ঘটনা।

Advertisement

এ দিন সকালে গ্রামের শতাধিক মহিলা দলবেঁধে ১০-১২টি মদের ভাটি ভাঙলেন। সেই সঙ্গে পরবর্তীতে গ্রামের আরও যে সমস্ত অবৈধ মদের ভাটি আছে সেগুলিও উচ্ছেদ করার অভিযানে নামার জন্য শপথ নিলেন। তাঁদের ক্ষোভ, গ্রামে মদের ভাটির জন্য প্রায় প্রতিটি ঘটে অশান্তি তো লেগেই থাকে। মদ খেয়ে বধূ নির্যাতনেরও ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, অন্য এলাকার লোকজন এসে দিনরাতে মদ খেয়ে গ্রামের মহিলাদের কটূক্তি করে। অবৈধ মদের কারবারের জন্য পরিবেশ দূষিত হচ্ছে দেখে এলাকার মহিলারা ওই সমস্ত মদ ব্যবসায়ীদের সাত দিন আগে তাদের কারবার বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার পরেও এলাকায় রমরমিয়ে অবৈধ মদ বিক্রি চলছে। কোনও কিছুতে কাজ না হওয়ায় বুধবার গ্রামের ঘটনাস্থল নলহাটি থানার সিমলান্দি গ্রাম।

এ দিন সকাল সাড়ে দশটার সময় গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, প্রায় শ’খানেক মহিলা কেউ কাঠ, কেউ বাঁশ হাতে বেআইনি মদ ব্যবসায়ী খুদু লেটের বাড়ির ভিতরে থাকা মদ তৈরির সরঞ্জাম বাইরে বের করে ভাঙছেন। মা-দুর্গা স্বনির্ভর দলের দলনেত্রী রেবতী লেটের তখনও রাগ মিটছে না। ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, “এদের লজ্জা হয় না। গ্রামের মা-বোনদের সম্মান নেই মনে করছে ওরা। দ্যাখ মেয়ে মানুষের শক্তি।” এর পরেই সঙ্গে থাকা মহিলাদের গ্রামের বটতলায় জড়ো হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন রেবতীদেবী। গ্রামের বটতলায় পাঁচ থেকে পঁয়ষট্টি সব বয়সের মহিলারা ভিড় করেছেন। সকাল ৮টা থেকে বেরিয়ে তাঁরা ১১টা পর্যন্ত গ্রামে ৯টি ভাটি ভাঙেন তাঁরা।

Advertisement

আলো স্বনির্ভর গ্রামের সহনেত্রী ইলা লেট, আর একটি স্বনির্ভর দলের দলনেত্রী সুপ্রিয়া লেট, গৃহবধূ কল্পনা লেটদের ক্ষোভ, “স্বামীরা মদ খেয়ে গালিগালাজ করে। বেশ কিছু দিন ধরে এই অত্যাচার চলেই আসছে। কিন্তু গ্রামের ভিতরে যখন মহিলারা তাদের কাজে যাচ্ছে কিংবা গ্রামের মহিলারা যখন চাষের কাজ বা ঘাস কাটতে যায় তখন অন্য গ্রামের লোকজন গ্রাম থেকে মদ খেয়ে মহিলাদের লক্ষ্য করে কটূক্তি করে। এর জন্য গ্রামের পথেঘাটে মহিলাদের বের হওয়া দায় হয়ে উঠেছে। এর জন্য সাত দিন আগে মদের ব্যবসায়ী থেকে গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য, অন্য শিক্ষিত যুবকদের বেআইনি মদ ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু দেখলাম কারও কোনও হুঁশ নেই। তখন আমরাই দলবদ্ধ হয় অবৈধ মদের ভাটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নিই। এবং সেই কাজ বোধনের দিন করা হবে।” সেই মতো এ দিন সকাল সকাল বোধনের ঘট ভরে মা দুর্গার আবাহন করে বেআইনি ভাটি ভাঙতে নেমেছেন বলে জানালেন বটতলা পাড়ার রতন্তী লেট, সাবিত্রী লেট, জ্যোস্না লেটরা।

এই সব ক্ষোভের কথা বলতে বলতে তাঁরা দিন দশেক আগের একটি ঘটনার কথা তুলেও ধরলেন প্রতিবাদী ওই সব মহিলারা। তাঁরা জানালেন, স্বামী ও শাশুড়ি একসঙ্গে মদ খাচ্ছে দেখে গ্রামের এক বধূ প্রতিবাদ করেছিলেন। পরিণামে বধূটির কপালে জুটেছিল স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতন। কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন বধূটি। পরে শাশুড়ি কীটনাশক খেলে স্বামী বধূটিকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। গ্রামের এক প্রৌঢ়া অনিমা লেট বললেন, “গ্রামের অনেক যুবক চেন্নাইয়ে রংমিস্ত্রির কাজ করে। তারা গ্রামে ফিরলে বাইরে থেকে খেটে আনা রোজগারের টাকায় মদ খেতে চলে যায়। সামনে পুজো আসছে। ওই সব ছেলেরা অনেকে বাড়ি ফিরবে। এর জন্য আগাম আমরা মদের ভাটি ভেঙে দিলাম।”

সিমলান্দি গ্রামের ওই সমস্ত মহিলাদের দাপট দেখে গ্রামের প্রৌঢ় বঙ্কিম লেট, যুবক সুমন্ত লেট, কিশোর শুভ লেটরা দাবি করেন, “পুলিশকে বলে কিছু হয়নি। আমাদের কথা ওরা পাত্তা দেয় না। সেই জন্য মহিলারা যখন এগিয়ে এসেছে তখন এ বার কিছু একটা হবে। এ বার মনে হয় বেআইনি মদের ভাটি বন্ধ হবে।” অন্য দিকে, গ্রামের বেআইনি মদের ভাটি মালিক খুদু লেট অবশ্য বললেন, “খুব বেশি মদ বিক্রি করি না। বিশ্বকর্মা পুজো বলে বিক্রি করছিলাম। অন্যায় করেছি আর হবে না।” রামপুরহাট মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস ওই গ্রামের মহিলাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “গ্রামে বেআইনি মদ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবগারি দফতর এবং পঞ্চায়েত প্রধান থেকে বিডিওকে বলা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন