মাধবগঞ্জের মদনগোপাল জিউ-এর মন্দির।
সে এক দিন ছিল।
তখন দোলযাত্রায় শুরু হয়ে টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে শহরের লালজিউ, মদনগোপাল, মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণ এবং বিভিন্ন চণ্ডী মণ্ডপে গান গাইত হোলির গানের দল। পাড়ায় পাড়ায় তারও মাস দুই আগে থেকে গড়া হত দল। চলত গানের মহড়া। তার পরে বিভিন্ন মন্দিরের আটচালায়, নাটমঞ্চে, বাঁধা প্যান্ডেলে রীতিমতো প্রতিযোগিতার ঢঙে শুরু হয়ে যেত গান। পুরস্কার বলতে ঠাকুরের ভোগ। দেওয়া হত মাটির খোলা ভর্তি চিঁড়ে। শ্রোতারা খুশি হয়ে গায়কের বুক পকেটে গেঁথে দিতেন পাঁচ-দশ টাকার নোট।
সে এক দিন ছিল। কিন্তু আজ সে সব কোথায় বাঁকুড়ার মন্দির শহর বিষ্ণুপুরে?
দোল আসে, দোল যায়। কিন্তু, রঙের সঙ্গে আর ওড়ে না দোলের গানের সুর। পুজো প্রাঙ্গণে রাতের আসর মাতিয়ে দেওয়া সেই ‘হোলির গান’-এর ঐতিহ্য হারিয়েই গিয়েছে বাংলার প্রাচীন এই জনপদ থেকে। যা নিয়ে আজও আক্ষেপ শোনা যায় স্থানীয় সঙ্গীত রসিকদের মুখে।
মাধবগঞ্জের মদনগোপাল জিউ-এর মূর্তি।
শহরের কিছু প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন, কৃষ্ণ-রাধিকার বিরহ-মিলন রূপ পেত দোলের সেই সব গানে। দরবারি কানাড়ায় কেউ গাইতেন ‘আজি বৃন্দাবনে কী শোভা লেগেছে গগনে/ তাই তো রেখেছি নাম/ আজি ওই ঘনশ্যাম/ যেও না শ্যাম তুমি একা একা/ হাতিরাঙা রেঙে দেবে তোমারি সখা’। ছিল সমসাময়িক বিষয়ও। স্বাধীনতা আন্দোলনে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে দোলের গানে ছিল ডাক ‘সিঙ্গাপুরে সুভাষচন্দ্র বলেন এই বাণী/ রক্ত যদি দিতে পারো ভারত মুক্ত হবে এখনই।’ স্থানীয় বাঁধগাবা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দোরে সময়েই তো গাওয়া হয়েছিল‘এই দুনিয়ায় তোরাই মালিক, তোরাই রাজা, বাদশা-নবাব/ তোদের মাটি, তোদের জমি, মাটির মালিক তোরাই খাঁটি/ বুক ফুলিয়ে ধররে লাঠি, মুখ ফুটে দে স্পষ্ট জবাব’।
কৃষ্ণগঞ্জের রাধালাল জিউ-এর মূর্তি।
বিষ্ণুপুরের বিশিষ্ট ধ্রুপদ সংগীতশিল্পী সুজিত গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এই ধরনের গানেও এক সময় ধ্রুপদ সংগীতের ছোঁয়া ছিল। পরবর্তী কালে সমসাময়িক ঘটনা ঢুকে দোলের গান অন্য ধরনের জনপ্রিয়তা পায়। ইদানীং সেই চলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হারাতে বসেছে সেই গানের কলি।”
দশ-পনেরো জনকে নিয়ে গড়া হত এক একটি গানের দল। মূল গায়ক একজন। বাকিরা ধুয়ো ধরতেন আর বাজাতেন খোল-করতাল, ডুগি-তবলা। শিল্পীদের কেউ রিকশা চালক, কেউ দিনমজুর, কেউ বা সরকারি চাকুরে। গানের দলে ছিল না কোনও ভেদাভেদ। ’৯০-এর দশক থেকেই ভাটা পড়তে থাকে হোলির গানে। ওই দলে আগে যাঁদের নিয়মিত পাওয়া যেত, সেই বলরাম দাস, নীলমণি দাস, তারাপদ দাসরা উদাসীন। তাঁদের কথায়, “এখন আর সময় কই? প্রায় মাস দুয়েকের মহড়া। তার পরে মাসখানেক ধরে বাজনা নিয়ে রাতভোর ঘুরে বেড়ানো। এতে কি আর পেট চলবে?”
কৃষ্ণগঞ্জের রাধালাল জিউ-এর মন্দির।
কৃষ্ণগঞ্জ ষোল আনা কমিটির সভাপতি, বিষ্ণুপুর পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রবিলোচন দে বলেন, “লালজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে দোলের রাতে আগে অনেক গানের দলকে আমন্ত্রণ করে আনতাম। এখন দলের খোঁজ পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে আমাদের মন্দিরের সংকীর্তন দলকে দিয়েই হোলির গান গাওয়ানো হয়।” বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান তথা রাজ্যের বস্ত্র মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানান, বিষ্ণুপুরের প্রাচীন লোকধারার হোলি ও তুষুর গান ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তাঁরা উদ্যোগী হয়েছেন। বার্ষিক প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে। তবু তরুণ প্রজন্মর কাছে তেমন সাড়া নেই।
মানুষের জীবন যাত্রার বদলই এই গান হারিয়ে যাওয়ার কারণ জানিয়ে ইতিহাসবিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “আধুনিকতার নামে দ্রুতগতির জীবনে আমরা বহু লোক ঐতিহ্যকেই হারাতে বসেছি। দোলের গানও সে ভাবে হারাচ্ছে। তবে ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে।”
ছবি: শুভ্র মিত্র।