নকশা বদলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই বালুচরীর

নবাবের অন্দরমহলে যে শাড়ি ঝলমল করত, বিষ্ণুপুরের তাঁতিদের হাত ধরে সেই বালুচরী এখন মধ্যবিত্তের ঘরে। কিন্তু কাঞ্জিভরম, ঘিচা, চান্দেরী বালুচরীর বাজার কিছুটা কেড়ে নিয়েছে। বাজার ধরার লড়াই চলছে। কী ভাবে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।বালুচরী আর বিষ্ণুপুর যেন সমার্থক। তা যেমন বনেদিয়ানায়, তেমনই ঐতিহ্যেও। বিষ্ণুপুরে বেড়াতে এসে অনেক রসিকজন তাই বালুচরী কিনে নিয়ে যান। গর্ব করে আত্মীয়দের দেখান। নবাবি আমলের এই শাড়ির ধাপে ধাপে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

Advertisement

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০১:৩২
Share:

সুদিন গিয়েছে, নতুনত্ব এনে বাজার ধরার চেষ্টা চলছে। ছবি: শুভ্র মিত্র।

বালুচরী আর বিষ্ণুপুর যেন সমার্থক। তা যেমন বনেদিয়ানায়, তেমনই ঐতিহ্যেও। বিষ্ণুপুরে বেড়াতে এসে অনেক রসিকজন তাই বালুচরী কিনে নিয়ে যান। গর্ব করে আত্মীয়দের দেখান। নবাবি আমলের এই শাড়ির ধাপে ধাপে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবুও বালুচরীর সেই সুদিন এখন অনেকটাই ফিকে।

Advertisement

দক্ষিণী শাড়ির জলুস আর দামের পাল্লা কম হওয়ায় বাজারে কোণঠাসা বালুচরী। তবুও কেউ কেউ বালুচরীর পুরনো বাজার ফিরে পাওয়াপ আশায় এখনও তাঁত নিয়ে সাত সকালে শাড়ি বুনতে বসে পড়েন। কেউ কেউ শাড়ি বুনেই শাড়ির গোছা নিয়ে বাজার ধরতে হিল্লি-দিল্লি চক্কর মারছেন। মরা গাঙে জোয়ার নিয়ে আসার আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

মন্দির নগরী বিষ্ণুপুরের নামের সঙ্গে এখন বালুচরী জুড়ে গেলেও এর জন্ম কিন্তু এই লালমাটির শহরে হয়নি। নবাব বাড়ির অন্দরমহলের এই শাড়ি হাত বদলে চলে আসে মল্লরাজাদের সাবেক রাজধানী বিষ্ণুপুরে। ইতিহাস জানাচ্ছে, ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের পরে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ অন্দরমহলের বেগমসাহেবাদের জন্য নতুন শাড়ি তৈরির হুকুম দেন স্থানীয় বালুচর গ্রামের তাঁতশিল্পীদের। ঢাকাই মসলিনের উত্তরসূরি হিসেবে সেই সময়ে তাঁদের হাত ধরে বাংলায় বালুচরী শাড়ির আবির্ভাব ঘটে। নবাবি জমানা শেষ হলে ওই গ্রামেই শেষ হয়ে যায় রেশমী সুতোয় বোনা অসাধারণ নকশায় ঝলমলে এই শাড়িটির বয়ন প্রক্রিয়া।

Advertisement

কিন্তু হারিয়ে যায়নি বালুচরী। কলকাতার হস্তশিল্প দফতরের রিজিওনাল ডিজাইন সেন্টারের অধিকর্তা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শুভো ঠাকুর। তিনি বালুচর গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে বালুচরী শাড়ির একটি আঁচলা উদ্ধার করেন। ওই সেন্টারে তখন নকশা-শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন বিষ্ণুপুরের তাঁত শিল্পী অক্ষয় দাস। শুভো ঠাকুরের নির্দেশে ওই আঁচলের নকশা করেন অক্ষয়বাবু। নতুন ভাবে তৈরি হয় বালুচরী শাড়ি। কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরে ফিরে এলাকার বস্ত্র ব্যবসায়ী ভগবানদাস সারদার আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালে অক্ষয়বাবু ফের শুরু করেন বালুচরী শাড়ির পুনর্বয়ন। বিষ্ণুপুরে শুরু হয় বালুচরী শাড়ির পথচলা।

বিষ্ণুপুরের তাঁতিরা সেই সময়ে শাড়ি, চাদর, গামছা বুনতেন। রেশমি সুতোর নতুন শাড়ি কিছু দিনের মধ্যেই ক্রেতাদের মন টানে। একে একে বিষ্ণুপুরের ঘরে ঘরে তাঁতশালে শুরু হয় বালুচরীর বুনন। পরের তিন দশকে এই শহরে ১০০০-র বেশি তাঁতে বালুচরী তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে। রেশম সুতো থেকে শাড়ি তৈরির বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন ১০ হাজারের বেশি তাঁত শিল্পী।

বিপণন জোর পায় ৭০ দশকের শেষের দিকে। দখতে দেখতে এই শহরে তৈরি হয় শুধুমাত্র বালুচরী শাড়ির কয়েকটি দোকান। সেখান থেকে বড় ব্যবসায়ীদের বিক্রির সঙ্গে পর্যটকদেরও খুচরো বিক্রি করা হয়। ওই ব্যবসায়ীদের নিজস্ব তাঁতে শাড়ি বোনা হয়। রাজ্য সরকারের তন্তুজ, তন্তুশ্রী প্রভৃতি বিপণন দফতর থেকেও বিষ্ণুপুরের বালুচরী কিনে নিয়ে যেতে শুরু করে। কলকাতা-সহ দেশের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে বালুচরী। মজবুত বাজার পেয়ে তখন সুদিন ফেরে বিষ্ণুপুরের তাঁতিদের। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের তখন রমরমা ব্যাপার। স্বর্ণযুগ ছিল ২০০০ সাল পর্যন্ত।

এরপরেই ধাক্কা লাগে। প্রবীণ শিল্পীদের কথায়, সেই সময়ে রেশম সুতোর দাম বেশ বেড়ে যায়। মালদহ, বেঙ্গালুরু থেকে চড়া দরে রেশম নিয়ে এসে কম দামে শাড়ি বিক্রি করা যাচ্ছিল না। এই সময়েই তুলনায় কম দামে, নতুন নকশার শাড়ি এনে বাজারে থাবা বসায় দক্ষিণের শাড়ি। শাড়ি রসিকরা ধীরে ধীরে বালুচরীর দিক থেকে মুখ ঘোরাতে থাকেন। বাজার থেকে টাকাও আসা বন্ধ হয়। ততদিনে মহাজনি ফাঁদেও তাঁতিরা জেরবার হয়ে পড়েছিলেন। পাড়ায় পাড়ায় তাঁত যন্ত্র চলার খটাখট শব্দ কমে আসে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় তাঁত যন্ত্র। এখন মেরেকেটে সাড়ে তিনশো তাঁত চলছে। কিছু তাঁতি পৈতৃক পেশা ছেড়ে পেটের টানে রিকশা চালানো, লটারি বিক্রি করা, দিনমজুরির কাজে নামেন। কয়েকজন বালুচরীর বদলে তাঁতযন্ত্রে ফের চাদর, গামছা বোনা শুরু করেন। বিষ্ণুপুরের মলডাঙার তাঁত শিল্পী গৌতম দাস বলেন, “বাবা ও আমি বালুচরী শাড়ি তৈরি করতাম। এখন চাদর বুনছি।”

তবে কেউ কেউ থামতে চাননি। যেমন প্রবীণ শিল্পী গুরুদাস লক্ষণ শাড়িতে সোনালি সুতোর জরির কাজ যোগ করে তৈরি করেন ‘স্বর্ণচরী শাড়ি’। সেই শাড়ি নতুন করে বাজার ধরতে শুরু করে। তিনি নকশার চেনা ছক ভাঙারও চেষ্টা করেছিলেন। সেই কাজ তিনি এখনও করে যাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মের তাঁতশিল্পী অমিতাভ পালও নকশায় বৈচিত্র্য আনছেন। তাঁর কথায়, “প্রচলিত নকশার বাইরে নতুন নকশা তৈরি করে বালুচরীতে অভিনবত্ব নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছি। সেই সঙ্গে বিপণনেও জোর দিয়েছি।” একসময় যাঁরা ভেবেছিলেন বালুচরীর দিন বুঝি শেষ, তাঁদের সেই ধারণা ভাঙার কাজ করে যাচ্ছেন গুরুদাসবাবু, অমিতাভবাবুর মতো অল্প কয়েকজন তাঁতশিল্পী। বিপণনের প্রচলিত ছক ভেঙে অমিতাভ নিজেই শাড়ি নিয়ে সারা দেশময় দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। দিল্লি থেকে চেন্নাই, কলকাতা থেকে মুম্বইয়ের বিভিন্ন মেলায় বিষ্ণুপুরের বালুচরীকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন। এ ভাবেই বিদেশে বাজারেও বিষ্ণুপুরের বালুচরী নতুন করে ছড়াচ্ছে।

চ্যালেঞ্জও আছে। অমিতাভবাবুর কথায়, “সুতোর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি লোকের মজুরি বেড়েছে। আগে একটি তাঁত থেকে মাসে ৬০০০ টাকা লাভ হলেও এখন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।” গুরুদাসবাবুর আক্ষেপ, “স্বর্ণচরী শাড়ি তৈরি করে বাজার ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু জরির দাম অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সেই শাড়িও বাজারে মার খাচ্ছে।” তবে এলাকার বিধায়ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এখন রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী। তাঁর আশ্বাস, “বালুচরী শিল্পীদের নিয়ে আমাদের ভাবনা রয়েছে। এই শাড়ি যাতে অন্য রাজ্যের শাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে সে জন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা নিচ্ছি।” শেষ পর্যন্ত তিনি কী করেন, সে দিকেই তাকিয়ে বিষ্ণুপুরের তাঁতশিল্পীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন