পাত্রসায়রে ফিরেছে সেই চেনা অশান্তি, মার খাচ্ছে ব্যবসাও

একটা সময় লড়াই ছিল সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের। এখন সিপিএম নেই। লড়াই তাই শাসক দল তৃণমূলের ভিতরেই! যখন-তখন বোমাবাজি, মারপিট। সঙ্গে এক গোষ্ঠীর পার্টি অফিস ভাঙচুর অন্য গোষ্ঠীর। আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। ব্যবসাপত্র লাটে ওঠার জোগাড়। রাজনৈতিক সন্ত্রাস-দীর্ণ পাত্রসায়রে এখন এটাই ঘোর বাস্তব। খোঁজ নিল আনন্দবাজার। আজ প্রথম কিস্তি।একটা সময় লড়াই ছিল সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের। এখন সিপিএম নেই। লড়াই তাই শাসক দল তৃণমূলের ভিতরেই! যখন-তখন বোমাবাজি, মারপিট। সঙ্গে এক গোষ্ঠীর পার্টি অফিস ভাঙচুর অন্য গোষ্ঠীর। আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। ব্যবসাপত্র লাটে ওঠার জোগাড়। রাজনৈতিক সন্ত্রাস-দীর্ণ পাত্রসায়রে এখন এটাই ঘোর বাস্তব। খোঁজ নিল আনন্দবাজার। আজ প্রথম কিস্তি।

Advertisement

দেবব্রত দাস

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০১:১৪
Share:

ভাঙচুরের পরে বালসি গ্রামে তৃণমূলের পার্টি অফিস। অভিযোগ উঠেছিল দলেরই অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। —ফাইল চিত্র

হঠাৎ কয়েকটা বোমা ফাটার শব্দ। মুর্হূতের মধ্যে রাস্তা থেকে উধাও লোকজন। ঝপাঝপ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। দরজা-জানলা বন্ধ করে দিলেন গৃহস্থ।

Advertisement

পাঁচ বছর আগের এই ছবিটাই ফিরে এসেছে পাত্রসায়রে। তফাৎ একটাই, তখন লড়াই হত সিপিএম এবং বিরোধী তৃণমূলের মধ্যে। এখন শাসকদলের তৃণমূলের নিজেদের মধ্যেই লড়াই দেখছেন পাত্রসায়রবাসী। উদ্দেশে সেই একই এলাকার ক্ষমতা ধরে রাখা।

বিধানসভা নির্বাচনের পরে পাত্রসায়র কিছুটা শান্ত হলেও বছর ঘুরতেই ক্রমশ তাততে শুরু করে এলাকা। তৃণমূলের ব্লক নেতাদের মধ্যে গোষ্ঠীবদল হয়েছে বারবার। ততই একপক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। যার প্রেক্ষিতে বিপর্যস্ত হয়েছে এলাকার জনজীবন। বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই-ই নয়, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দলাদলির জেরে এলাকার উন্নয়নের কাজও ব্যাহত হচ্ছে।

Advertisement

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই অশান্ত হয়ে ওঠে পাত্রসায়র এলাকা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত এলাকায় সিপিএম-তৃণমূলের সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েকজন খুনও হন। বিধানসভা নির্বাচনের পরে সিপিএমের বহু কর্মী-সমর্থক এলাকা ছাড়া হন। তারপর থেকে লড়াই শুরু হয় তৃণমূলের নিজেদের মধ্যেই। লোকসভা নির্বাচনের পরে এলাকায় ব্যক্তিগত প্রভাব বজায় রাখা নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে লড়াই মাত্রাছাড়া আকার নেয়।

দলের কর্মীরাই অন্য গোষ্ঠীর দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছে। কর্মীদের বেধড়ক মারধর করা চলছেই। আর গণ্ডগোলের পরেই এক পক্ষ এলাকায় শান্তিমিছিলের নামে শক্তিপ্রদর্শন করছেন। আর এ জন্য গাঁ উজিয়ে লোকজনকে বাসভাড়া করে পাত্রসায়র সদরে তুলে আনা হচ্ছে। যদিও সংঘর্ষ তাতে বন্ধ হয়নি। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের খেয়োখেয়ি দেখে তিতিবিরক্ত এলাকার বাসিন্দারা। একই সঙ্গে রীতিমতো আতঙ্কিতও তাঁরা।

রাজনৈতিক অশান্তির জেরে পাত্রসায়রের কাঁকরডাঙা মোড়, বাসস্ট্যান্ড, পাত্রসায়র বাজার, বালসি, ধগড়িয়া, বেতুড়, রসুলপুর এলাকায় সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট কার্যত সুনশান হয়ে পড়ছে। যে কোনও এলাকায় গণ্ডগোল হলেই নিমেষের মধ্যে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসা মার খাচ্ছে। মাথায় হাত পড়েছে ব্যবসায়ীদের। এক ব্যবসায়ী বলেন, “কয়েক মাস আগেও পাত্রসায়র বাজার গমগম করত। এখন সন্ধ্যার পর থেকেই বাজার ফাঁকা হতে শুরু করে। আশেপাশের গ্রামের মানুষ এখন বাজার, বাসস্ট্যান্ডে সন্ধ্যার পরে থাকতে ভয় পাচ্ছেন। খদ্দের না থাকায় আমাদের ব্যবসা মার খাচ্ছে।” তাঁর মতোই অনেক ব্যবসায়ীর চিন্তা, পুজোর বাজার আদৌ জমবে তো?

পাত্রসায়র কলেজের এক ছাত্রীর বক্তব্য, “কলেজে যেতে ভয় হয়। কখন কোন দাদার ভাইয়েরা রাস্তা আটকে আমাদের সঙ্গী কোন ছাত্রকে পেটাবে তা নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকি।” স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে মারপিটের জেরে এলাকা কার্যত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে। যে এলাকায় যার প্রভাব বেশি তারা বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনকে মারধর করছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। শান্তিমিছিল, মহামিছিল, সভা চলছেই। প্রাণভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে তৃণমূলের কার্যালয় পাহারা দিতে হচ্ছে পুলিশকে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রামে গ্রামে পুলিশবাহিনী মোতায়েন করতে হচ্ছে। যে কোনও ঘটনা ঘটলেই দু’পক্ষ পুলিশের কাছে মামলা ঠুকছে। বহু নিরীহ মানুষের নামেও মিথ্যা কেস দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। আগে সিপিএমের লোকেরা যা করত এখন তৃণমূলের লোকেরা সেই একই কায়দায় দলের বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনকে জব্দ করতে মিথ্যা অভিযোগ করছে বলেও দলের একাংশের ক্ষোভ। পুলিশ অবশ্য দু’একজনকে ধরে দায় সারলেও মূল অভিযুক্তদের ধরছে না বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, পুলিশ একটু সক্রিয় হলেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু পুলিশ হাত তুলে রয়েছে।

পাত্রসায়র প্রায় বিরোধীশূন্য। সিপিএম নেই বললেই চলে। বিজেপি থাকলেও তাদের সংগঠন আহামরি কিছু নেই। পাত্রসায়র ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদের আসন সবই তৃণমূলের দখলে। তা সত্ত্বেও তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে ছেদ পড়েনি।

দল সূত্রে খবর, একদিকে রয়েছেন তৃণমূলের পাত্রসায়র ব্লক সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়, সুব্রত কর্মকার, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝন্টু মিদ্যা, জিয়ারুল ইসলাম, বুদ্ধদেব পাল ও তাঁর অনুগামীরা। অন্যদিকে, একদা স্নেহেশবাবুর ঘনিষ্ঠ ব্লকের আর এক দাপুটে নেতা নব পাল, সুব্রত ওরফে গোপে দত্ত এবং বাবলু সিংহ ও তাঁর অনুগামীরা রয়েছেন।

এলাকার রাজনৈতিক সমীকরণে পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে স্নেহেশবাবুর কর্তৃত্ব রয়েছে। বাকি ৪টি পঞ্চায়েতে তাঁর বিরোধী শিবিরের প্রভাব রয়েছে। নব পাল পঞ্চায়েত ভোটের পর দলে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও লোকসভা নির্বাচনের পরে এলকায় ফের তাঁর প্রভাব বাড়ে। বর্তমানে নববাবুর সঙ্গে রয়েছেন স্নেহেশবাবুর একদা ঘনিষ্ঠ সুব্রত। স্নেহেশবাবুর অনুগামীদের দাবি, তাঁরা একজোট হয়ে ব্লক সভাপতির ক্ষমতা ছাঁটতে উঠে পড়ে লেগেছেন। অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া স্নেহেশবাবুর গোষ্ঠী। সেই কারণেই এলাকা দখলের জন্য ফের দুই গোষ্ঠীর কিছু লোক প্রকাশ্যে মারপিটের রাস্তায় নেমেছেন বলে দলের নিচুতলার কর্মীদের অভিযোগ।

নব পালের দাবি, “আমি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ মেনে কাজ করছি। ব্লক স্তরের কয়েকজন নেতা দলের দুর্দিনে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের চরমভাবে দিনের পর দিন অপমান করেছেন। আমি বা আমার সঙ্গীরা কেউ অশান্তি ছড়াচ্ছেন না। সব মিথ্যা অভিযোগ।” তাঁর বিরোধী বলে পরিচিত স্নেহেশবাবুর পাল্টা দাবি, “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শের বাইরে গিয়ে কিছু নেতা-কর্মী অনৈতিক কাজ কারবার শুরু করেছেন। তাঁদের এই কাজে আমার গায়েও কালি লেগেছে। ওদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের আক্রমণ আমরা করিনি।”

তাঁরা মুখে হামলার কথা মানতে না চাইলেও পাত্রসায়রের বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে কাদের লোকজন দিনের পর দিন গোলমাল পাকাচ্ছে? দলের জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব স্থানীয় নেতাদের কেন এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তা নিয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরাও। জেলা নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নে দলের অন্দরেও ক্ষোভের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন