প্রাসাদে বিদ্যুৎ এনেছিল বাঁধের জল

মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীর ধারনগর, ঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট, মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় হয়ে কাশীপুর। একের পর এক জনপদ সরতে সরতে পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ রাজধানী হয়ে উঠেছিল কাশীপুর। আর ওই রাজাদের বদান্যতায় শুধু ইতিহাসেই নয়, সংস্কৃতির আরকেও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে কাশীপুর। দিগ্বিদিকের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে রীতিমতো ‘নবরত্ন’ সভা বসত রাজ দরবারে। সেই গৌরব এখন বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪০
Share:

পঞ্চকোট রাজাদের শেষ রাজধানী কাশীপুরের গর্ব রাজপ্রাসাদ। ছবিটি তুলেছেন সুজিত মাহাতো।

মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীর ধারনগর, ঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট, মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় হয়ে কাশীপুর।

Advertisement

একের পর এক জনপদ সরতে সরতে পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ রাজধানী হয়ে উঠেছিল কাশীপুর। আর ওই রাজাদের বদান্যতায় শুধু ইতিহাসেই নয়, সংস্কৃতির আরকেও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে কাশীপুর। দিগ্বিদিকের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে রীতিমতো ‘নবরত্ন’ সভা বসত রাজ দরবারে। সেই গৌরব এখন বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে।

১৮৩২-১৯১৪ এই সময়কালের মধ্যে কাশীপুরের এই বিরাট পরিবর্তন হয়েছিল। তা এসেছিল মূলত পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা নীলমণি সিংহদেও ও তাঁর সুযোগ্য নাতি জ্যোতিপ্রসাদ সিংহদেও-র হাত ধরে। ওই দু’জনের কৃতিত্বের নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে পঞ্চকোট রাজবাড়ি। এক সময় যে বাড়ির দরবার থেকে ভেসে আসত ঝুমুর, ভাদু থেকে বিষ্ণুপুর ঘরনার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। দরবার হল ভরে থাকত মৃদঙ্গের বোল আর বাঁশির মিঠে সুরে। কিন্তু সনাতন সংস্কৃতির সেই সব মণি-মানিক্য উদ্ধারের সরকারি প্রয়াস কোথায়? আক্ষেপ সংস্কৃতি প্রেমীদের। কেন এই রাজবাড়িকে ঘিরে পর্যটনের বিকাশ করা হল না?

Advertisement

ইতিহাস বলছে, ১৮৩২ সালে হুড়ার কেশরগড় থেকে রাজধানী দ্বারকেশ্বর নদের গাঁ ঘেষা কাশীপুরে তুলে নিয়ে আসেন পঞ্চকোট রাজ জগজীবন সিংহ দেও (গরুড় নারায়ণ)। এটি তাঁদের সপ্তম তথা শেষ রাজধানী। কাশীপুরে এই বংশের সাত রাজা জগজীবন, নীলমণি, হরিনারায়ণ, জ্যোতিপ্রসাদ, কল্যাণীপ্রসাদ, শঙ্করীপ্রসাদ ও ভুবনেশ্বরীপ্রসাদ রাজত্ব করেছিলেন। রাজধানী গড়ে উঠেছিল কাশীপুর, নপাড়া, রঙ্গিলাডি, গোপালপুর, গোপালচক, রামবনি, কল্লোলী মৌজাকে নিয়ে। কাশীপুরের বড়বাঁধে, কাশীপুর-বাঁকুড়া রাস্তার পাশে জোড়বাংলো মন্দিরের আদলে জগজীবনের বাবা মণিলালের সমাধি এখনও রয়েছে। মানভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, রাঁচি প্রভৃতি জেলায় এই বংশের জমিদারির বিস্তৃতি ছিল ২৭৭৯ বর্গ মাইল। পরবর্তীকালে রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহদেও কটক জেলার কিছু জমিদারি কেনেন।

জেলার ইতিহাস গবেষক দিলীপ গোস্বামীর কথায়, “সাত জন রাজত্ব করলেও কাজকর্মের নিরিখে উপরের দিকে দুই রাজা নীলমণি ও জ্যোতিপ্রসাদের নাম উঠে আসে। তৎকালীন মানভূমে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে তাঁদের দান বা সাহায্যের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।” তবে নীলমণি সিংহ দেও-র নাম অন্য কারণেও উল্লেখযোগ্য। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর নেতৃত্বেই পুরুলিয়া ট্রেজারি লুঠ হয়েছিল। পুরুলিয়া জেল ভাঙা আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। জেল ভেঙে ৬৩ জন কয়েদিকে মুক্ত করা হয়। কেশরগড় এলাকার সাঁওতাল সম্প্রদায় এই আন্দোলনে তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। ভীত হয়ে সাহেবরা পুরুলিয়া থেকে রঘুনাথপুর হয়ে রানিগঞ্জ পালিয়ে গিয়েছিলেন।

তখন তিনমাস পুরুলিয়া ব্রিটিশ-প্রশাসন মুক্ত ছিল। পরে পুলিশ নিয়ে এসে ক্যাপ্টেন ওকস নীলমণিকে গ্রেফতার করেন। কেউ বলেন, কলকাতার আলিপুরে তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছিল, কেউ বলেন শান্তিপুরে। পরে নীলমণিকে জামিনে মুক্ত করেন কাশিমবাজারের রানি স্বর্ণময়ী। বিনিময়ে তিনি স্বর্ণময়ীকে পঞ্চকোট রাজ্যের ৪৪টি মৌজা দান করেন। কারামুক্ত হয়েই তিনি পঞ্চকোটে নবজাগরণ আনার জন্য সক্রিয় হন। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত সঙ্গীত অধ্যাপক জগচ্চন্দ্র গোস্বামী, মৃদঙ্গবাদক হারাধন গোস্বামী, বংশীবাদক পূরণ সিংহ চৌতাল বা নবদ্বীপের ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, নৈয়ায়িক পার্বতীচরণ বাচস্পতি, কেদার ন্যায়রত্ন প্রমুখের মতো পণ্ডিতদের তিনি তাঁর রাজসভায় নিয়ে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য তিনি চালু করেন ‘পঞ্চকোট সংস্কৃত পুরস্কার’। ১৮৭২ সালে মধুসূদন দত্ত কিছুকাল রাজা নীলমণির আইন উপদেষ্টা হয়ে ছিলেন। মাইকেল কী ভাবে এখানে এলেন, সেও এক কাহিনি। তিনি একটি মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুলিয়ায় এসেছিলেন। তাঁর নামের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নীলমণি সে খবর পেয়েই পাল্কি ও লোকলস্কর পাঠিয়ে পুরুলিয়া থেকে মধুসূদনকে কাশীপুরে নিয়ে আসেন। তাঁর সাহিত্য কৃতীর সঙ্গে জুড়ে যায় কাশীপুর। এখানেই তিনি রচনা করেন ‘পঞ্চকোট গিরি’, ‘পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী’ ও ‘পঞ্চকোট গিরি বিদায় সঙ্গীত’ নামে তিনটি সনেট।

রাজা নীলমণির সেই ধারা পেয়েছিলেন রাজা জ্যোতিপ্রসাদ। এই দু’জনের রাজত্বকালে কাশীপুরে আরও কয়েকজন গুণীজনের সমাবেশ ঘটেছিল। যেমন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত শিক্ষক যদুভট্ট, ঝুমুরিয়া ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, কমলা ঝরিয়া, নর্তকী সিন্ধুবালা দেবী প্রমুখ। দেওঘরের ঝুমুরিয়া ভবপ্রীতানন্দ ওঝার ঝুমুরগ্রন্থ ‘বৃহৎ রসমঞ্জরী’ পঞ্চকোট প্রকাশনা থেকে চার খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। রাখালচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘পঞ্চকোটের ইতিহাস’ও তাঁর সময়েই পঞ্চকোট প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়।

জেলার বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অমিয়কুমার সেনগুপ্ত-র কথায়, “মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর শাসনকালে পঞ্চকোটকে এমনই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে ভারতের এই অঞ্চলের জমিদারির মধ্যে পঞ্চকোট শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করেছিল। বিদ্যোৎসাহী জ্যোতিপ্রসাদ কাশীপুরে নিজ ব্যয়ে মধ্য-ইংরেজি বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। পুরুলিয়ার লেডি ডাফরিন হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, কুষ্ঠাশ্রম, পশু চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।” তাঁর রাজ্যের অন্তর্গত ধানবাদ-আসানসোল এলাকায় পরবর্তীকালে মাটির নীচ থেকে কয়লা বের হওয়ায় তার ‘রয়্যালটি’ পান জ্যোতিপ্রসাদ। আর তা থেকেই তিনি রাজ্যকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। কাশীপুরে বর্তমান যে সুদৃশ রাজবাড়ি রয়েছে, তা জ্যোতিপ্রসাদেরই তৈরি। কাশীপুরের পুরাতনগড় এলাকা থেকে সরে এসে রামবনি মৌজায় ১৯১৬ সালে এই রাজবাড়ি তিনি তৈরি করেন চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে। টানা ১২ বছর ধরে চলেছিল নির্মাণ কাজ। বেলজিয়াম থেকে বিশাল ঝাড়লন্ঠন নিয়ে এসে লাগিয়েছিলেন প্রাসাদের দরবার হলে।

গবেষক দিলীপবাবু জানান, বিশাল জমাদার বাঁধের জল থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরি করে প্রাসাদে আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। ছিল নলবাহিত পানীয় জলের ব্যবস্থাও। তাঁর সময়েই তৎকালীন বিহার-ওড়িশার ছোটলাট এইচ এইচ বেইলি তাঁর ও সহধর্মিনী লেডি বেইলি কাশীপুরে আসেন। তাঁরা ১৯১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি কাশীপুর ও আদ্রার মধ্যে বেকো নদীর উপরে তৈরি করা সেতুর উদ্বোধন করেন। ওই সেতু তৈরি করেছিলেন জ্যোতিপ্রসাদই। কাশীপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের কুলদেবীর মন্দির দেবীবাড়িও তাঁরই তৈরি। দুর্গাপুজো, রাস উৎসব, দোল-সহ বিভিন্ন পুজো-অনুষ্ঠান ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হত। জ্যোতিপ্রসাদ তাঁর সময়ে স্বারস্বত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যাত্রা, নাটক, পালাগান, সঙ্গীত-সহ শিল্পচর্চার কেন্দ্র ছিল এই স্বারস্বত সমাজ। দিলীপবাবু বলেন, “দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান লোকগান ভাদু গানের প্রবক্তা ছিলেন রাজা নীলমণি। এই গানকে তিনি রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে তুলে দেন সাধারণ মানুষের কন্ঠে।” এলাকার বাসিন্দা সঙ্গীত শিল্পী উদয়ন ভট্টাচার্য বলেন, “এই স্বারস্বত সমাজের অন্যতম শিল্পী ছিলেন ধ্রুবেশ্বর লাল সিংহদেও। তাঁর সঙ্গে নজরুল ইসলামের যোগাযোগ ছিল। পঞ্চকোট ঘরানার একাধিক ভাদু গান ও কিছু নজরুল গীতির সুরের মধ্যে মিল রয়েছে।” দিলীপবাবুর আক্ষেপ, “এই ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে।”

রাজবাড়িতে যাতায়াত থাকা মানুষদের কাছ থেকে জানা যায়, ওই বাড়িতে এখনও যা রয়েছে, তাও দর্শণীয়। বেলজিয়ামের পেন্টিং করা কাচ, সুবৃহৎ ঝাড় লন্ঠন, পাথরের মূর্তি দেখলে রাজাদের রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। আবার রাজাদের শিকার করা মৃত বাঘ, সিংহ, বাইসন, চিতা প্রভৃতির দেহের ভিতর থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে খড় ভরে যে স্টাফড বা ট্যাক্সিডার্মি রাখা আছে তাও দেখার মতো। রয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত তরোয়াল, ঢাল, বর্শা ইত্যাদি যুদ্ধাস্ত্র। তবে রাজবাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ওই বাড়িতেই রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধররা থাকেন। শুধু পুজোর সময় রাজবাড়ির একাংশ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তাতে কি কৌতূহল মেটে?

রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম তথা পুরুলিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক কে পি সিংহদেও বলেন, “কাশীপুরকে বাদ দিয়ে পুরুলিয়ার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এই বাড়ি ঘিরে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আগে সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।” জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িকে ঘিরে যে রকম পিপিপি মডেলে পযর্টন কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে, এই রাজবাড়িকে ঘিরেও সে রকম ভাবনা রয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন