বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের পাঁচিল। ছবিগুলি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ, সুজিত মাহাতো ও শুভ্র মিত্র।
কেউ দেখে শেখে, কেউ ধমক খেয়ে। মঙ্গলবার বিকেলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী সাংবাদিক বৈঠকে জানান, কলকাতা ও দুই চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী বিধি যথাযথ ভাবে মান্য করা হচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় রাজ্য সরকারের প্রচারমূলক যাবতীয় পোস্টার, ব্যানার এবং হোর্ডিং খুলে ফেলার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন প্রশাসনকে। মুছে ফেলার নির্দেশ দেন সরকারি ভবনের দেওয়ালে রাজনৈতিক প্রচার। কমিশনারের নির্দেশ মেনে তড়িঘড়ি কাজে নামে কলকাতা পুরসভা এবং প্রশাসন। কলকাতার নজির দেখে টনক নড়েছে বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া প্রশাসনের। ধমক খাওয়ার আগেই বিধি মানতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা। তবে কোমর বাঁধলেও পুরোদস্তুর কাজে এখনও নামেনি প্রশাসন। বুধবার পর্যন্ত দুই জেলার বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবনের দেওয়ালে আকছার দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক প্রচার এবং পতাকা।
বাঁকুড়ার সোনামুখী হাসপাতালে ঢোকার মুখে মূল ফটকের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া পোলিও টীকাকরণের একটি পোস্টার চোখে পড়ত অনেকের। সেই পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পোস্টার ছিঁড়লেও অক্ষত অবস্থায় দেওয়ালে রয়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিটি। তা দেখে এক বিরোধী নেতার কটাক্ষ, ‘‘সরকারের প্রচার সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসনের আধিকারিকেরা বোধহয় বুঝতে ভুল করেছেন। টীকাকরণের প্রচার সরিয়ে সরকারের প্রচারটুকুই রেখে দিয়েছেন তাঁরা।’’
এ দিন পাত্রসায়রের কাঁকড়াশোল মোড়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনার রাস্তায় সরকারি দিক নির্দেশিকার উপর বহাল তবিয়তে উড়েছে তৃণমূলের পতাকা। বিষ্ণুপুর-সোনামুখী সড়কে জয়রামপুর ও মেটেপাতন গ্রামের মাঝে চুন দিয়ে তৃণমূলের প্রতীক আঁকা রয়েছে। বাঁকুড়া শহরের কোর্ট চত্বর-সহ বিভিন্ন স্কুল কলেজের দেওয়ালেও দেখা গিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচার এবং তাদের শাখা সংগঠনগুলির সম্মেলনের পোস্টার। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্রের অভিযোগ, কিছু দিন আগে সর্বদলীয় বৈঠকে তাঁরা বিষয়টি তুললেও সরকারি দেওয়ালে রাজনৈতিক প্রচার মোছার কাজে ঢিলেমি করেছে প্রশাসন। তাঁর আরও অভিযোগ, শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলও ছেয়ে গিয়েছে এ ধরণের অবৈধ প্রচারে।
তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, নিয়ম মেনেই প্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি বেনিয়মের দিকে তাঁদেরও কড়া নজর রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তবে সরকারি ভবনের সমস্ত দেওয়াল যে এখনও সাফ সুতরো করে ফেলা যায়নি তা স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা। তিনি বলেন, “ব্লকগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও সব নির্মূল হয়নি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’’ ওই আধিকারিক জানান, কোথাও সরকারি দেওয়াল বা রাস্তাঘাট রাজনৈতিক প্রচারের কাজে লাগানো হওয়ার খবর মিললেই বিশেষ দল গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এ দিন একই ছবি দেখা গিয়েছে পুরুলিয়াতেও। প্রশাসন সূত্রের খবর এই জেলায় আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি সংক্রান্ত নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অণগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের এক আধিকারিককে। ওই দফতরের ঠিক পিছনেই রয়েছে আবগারি দফতরের ভবন। আর সেই ভবনের দেওয়ালে এ দিন দেখা গেল কর্মচারি সংগঠনের কনভেনশনের বেশ কয়েকটি পোস্টার। পোস্টারে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি।
বিষ্ণুপুরের দ্বারিকায় ও বিষ্ণুপুর-সোনামুখী রাস্তায় মেটেপাতন গ্রামে।
দুপুরে দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে পৌঁছে দেখা গেল, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, স্বল্পক্ষত চিকিৎসা কেন্দ্র এবং ডায়ালিসিস পরিষেবা যে ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়’ চালু হয়েছে তা এখনও ঘোষণা করে চলেছে হাসপাতাল চত্বরের বড় বড় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং। তবে সংবাদমাধ্যম হাজির দেখে এ দিন হঠাৎ নড়চড়ে বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিষেবা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলিতে ঢেকে দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর নাম। পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘এই সরকার নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করে না। না হলে নির্বাচন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত হোর্ডিং খুলে ফেলা উচিৎ ছিল।’’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, পুরুলিয়া বিধানসভা কেন্দ্র এলাকায় বুধবার পযর্ন্ত সরকারি দেওয়াল থেকে মোছা হয়েছে ৩০টি দেওয়াল লিখন। তুলে ফেলা হয়েছে ৭২টি পোস্টার, খোলা হয়েছে ৫টি হোর্ডিং। বিদ্যুতের খুঁটি এবং সরকারি জায়গা থেকে খুলে ফেলা হয়েছে ১৫১টি রাজনৈতিক পতাকা। জেলা জুড়ে বিজ্ঞাপন সরানোর এ ধরণের মোট ২৩৪টি ঘটনা এ দিন পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়েছে বলে প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান। তাঁর দাবি, আদর্শ আচরন বিধির দিকে কডড়া নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু আইনভঙ্গের এ হেন নজির যে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যায়নি তা স্বীকার করে নেন তিনিও।
এই প্রসঙ্গে জেলার এক বিরোধী নেতার মন্তব্য, ‘‘কাজটা সত্যি কঠিন। সরকার যে হারে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দিয়ে সমস্ত কাজের প্রচার করেছে, তাতে হোর্ডিং খুলতে গাঁ উজার হয়ে যাবে।’’