আট মাস ধরে তালা ঝুলছে বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে

প্রশ্নের মুখে মাটি উৎসবের আয়োজন

আট মাস ধরে ব্যাঙ্কের সমস্ত শাখায় তালা ঝুলছে। যার সরাসরি ধাক্কা লেগেছে জেলার সমবায় ব্যবস্থায়। ঘোর সঙ্কট নেমে এসেছে বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রাহকের জীবনযাপনে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বিপাকে পড়েছেন আরও বহু মানুষ। কিন্তু, বারবার প্রতিশ্রুতি মিললেও কবে ব্যাঙ্ক খুলবে, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাড়ে তিনশো কোটি টাকার ভবিষ্যতই বা কী, এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোনও স্পষ্ট দিশা মেলেনি।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০৯
Share:

আট মাস ধরে ব্যাঙ্কের সমস্ত শাখায় তালা ঝুলছে। যার সরাসরি ধাক্কা লেগেছে জেলার সমবায় ব্যবস্থায়। ঘোর সঙ্কট নেমে এসেছে বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রাহকের জীবনযাপনে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বিপাকে পড়েছেন আরও বহু মানুষ। কিন্তু, বারবার প্রতিশ্রুতি মিললেও কবে ব্যাঙ্ক খুলবে, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাড়ে তিনশো কোটি টাকার ভবিষ্যতই বা কী, এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোনও স্পষ্ট দিশা মেলেনি।

Advertisement

এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই বীরভূমের কয়েকটি ব্লকে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘মাটি উৎসব’। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগামী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলার ১৯টি ব্লকেই ওই উৎসবের আয়োজন করা হবে। মাটি, কৃষি, উদ্যানপালন, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং সমবায় এই পাঁচের সমন্বয়েই এই উৎসব। যেখানে তুলে ধরা হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের উন্নয়নমূলক কাজের খতিয়ান। পাশাপাশি রাজ্য সরকার কোন কাজকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তা নিয়ে সরকারের ভাবনা-চিন্তার আগামী দিনের রূপরেখাও ওই উৎসবে তুলে ধরা হবে। যদিও সমবায় ব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িতদের একাংশ প্রশ্ন তুলেতে শুরু করেছেন, ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার জেরে যখন জেলায় ক্ষুদ্র চাষি থেকে প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি-বড় ব্যবসায়ী, সমবায় সমিতি, সাধারণ গ্রাহক চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, এ রকম চরম অনিশ্চিয়তার সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই ‘মাটি উৎসব’ করার যৌক্তিকতা কোথায়?

ঘটনা হল, বিপুল অনাদায়ী খেলাপি ঋণের জন্য গত ১৫ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করেছে। তার পর থেকেই জেলার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখাতেই সব ধরনের লেনদেন বন্ধ রয়েছে। নিজেদের জমানো টাকা তুলতে না পারায় জেলাজুড়ে ওই ব্যাঙ্কের প্রায় আড়াই লক্ষেরও বেশি আমানতকারীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। তাঁদের গচ্ছিত মোট ৩৫০ কোটি টাকার ভবিষ্যত কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমস্যার আঁচ এসে পড়েছে ওই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত জেলার কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতিগুলিও। প্রশাসন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও জেলার ৩৩১টি কৃষি উন্নয়ন সমিতির মধ্যে অন্তত ৯৫টি সমবায়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেই সব সমিতির অধিকাংশেরই ৭০ শতাংশের বেশি অমানত কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় গচ্ছিত রয়েছে। ফলে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমানতকারীদের টাকাপয়সা ফেরানোর ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যায় পড়েছে ওই সমবায় সমিতিগুলিও। খরিফ মরসুমে কৃষিঋণ না পেয়ে আগেই সমস্যায় পড়েছেন জেলার অসংখ্য প্রান্তিক চাষি। এমনকী, লেনদেন বন্ধের জেরে উপভোক্তারা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ১০০ দিন কাজের প্রকল্প, মিড-ডে মিল, বার্ধক্য-বিধবা-অক্ষম ভাতা, রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার (আরকেভিওয়াই) মতো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের টাকাও তুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ।

Advertisement

জেলা কৃষি দফতর সূত্রের খবর, মাটি উৎসবে বিভিন্ন ব্লকের চাষিদের কিষান কার্ড নিয়ে সচেতন করা হবে। প্রয়োজনে শিবির করে ওই কার্ড বিলি করা হবে। এ ছাড়া কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, উন্নত প্রজাতির বীজ ব্যবহার নিয়েও সচেতন করা হবে। পাশাপাশি কৃষকদের ভর্তুকি দিয়ে কৃষি সরঞ্জাম দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে উৎসাহী করা হবে। জেলা কৃষি আধিকারিক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “প্রতিটি ব্লকের উৎসবে এলাকার তিন জনকে (প্রাণিসম্পদ, কৃষি, উদ্যান, মৎস্য প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে) পুরস্কৃত করা হবে।”

এ দিকে, ওই সমবায় ব্যাঙ্কের সঙ্কটের কথা স্মরণে রেখেও ‘মাটি উৎসব’ আয়োজনে খারাপ কিছু দেখছেন না জেলার সভাধিপতি তথা ওই উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান বিকাশ রায়চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের সরকার মানুষের জন্য কাজ করতে চাইছে। সেটা তুলে ধরার জন্যই কৃষি, উদ্যানপালন, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং সমবায় দফতর একযোগে কাজ করছে। তারা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের দৃষ্টিভঙ্গি এই উৎসবে তুলে ধরবে। এর সঙ্গে ওই ব্যাঙ্ক খোলা বা বন্ধের তো কোনও বিরোধ নেই!” উল্টে তাঁর দাবি, “সমবায় ব্যাঙ্ক বন্ধ মানেই সমবায় সমিতিগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এ কথা ঠিক নয়। সমবায় ব্যাঙ্ক খোলার জন্য রাজ্য সরকার ভীষণ ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।” উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান আরও জানান, রাজ্য সরকার যে সমস্ত কাজে অগ্রাধিকার দিতে চায়, তার কথাই তিন দিন ধরে ওই উৎসবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে।

যদিও সরকারের এই ‘অগ্রাধিকার’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বীরভূমের প্রাক্তন সাংসদ তথা নতুন সিপিএম জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোম। তাঁর বক্তব্য, “সরকারের কাছে আমার অনুরোধ ঘটা করে সরকারি ফিরিস্তি দেওয়া উৎসব না করে গরিবের উন্নয়নে ওই টাকা খরচ করুন। ওই উৎসব বেশি জরুরি, নাকি জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ যার উপর নির্ভরশীল, সেই কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ককে বাঁচিয়ে তোলা?” তাঁর দাবি, “লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ সমবায় ব্যাঙ্কে টাকা রেখে দিশাহীন ভাবে ঘুরছে। তাঁদের ভাগ্য আজ সরকারি ফাইলে বন্দি। চাষিরা সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সমবায় সমিতি থেকে এ বার খারিফ, বোরো মরসুমে চাষ করার জন্য ঋণ পেলেন না। ওঁদের মহাজনি ঋণের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। চাষি যে ফসল ফলাচ্ছে, তার উপযুক্ত দামও মিলছে না। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের আত্মহত্যা ছাড়া তো আর কোনও পথ খোলা রাখছে না এই সরকার!”

সিপিএমের এই দাবিকে নস্যাৎ করেছেন কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বাম আমলেই তো ব্যাঙ্কের যা গণ্ডগোল হওয়ার হয়েছে। কোন মুখে ওঁরা এ সব কথা বলছেন! ব্যাঙ্ক বাঁচাতে ওরা কী করেছিলেন? উল্টে আমরাই তো সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছি। ব্যাঙ্ক খুলবে। খুব শীঘ্রই খুলবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন