চম্পাবতীর মৃত্যুর পর নির্মাণ হয়েছে এই মাজার।
এই সেদিনও যা ছিল ডাকাতদের মুক্তাঞ্চল, এখন সেই ইলামবাজার জঙ্গলই পর্যটনের ডাক দিচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর গ্রামে গড়ে উঠছে নতুন নতুন পান্থশালা, লোক-সংস্কৃতির মঞ্চ।
এখানকার জঙ্গলের জনশ্রুতিটিও জনপ্রিয়। জনশ্রুতি বলে, প্রায় পাঁচশ বছর আগে ওড়িশা থেকে চম্পাবতী নামে এক বালিকা তাঁর বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন এখানকার জঙ্গল এলাকায়। ডাকাতদের আক্রমণে চম্পা অপহৃত হয়। কিছু দিন খোঁজাখুঁজির পর মেয়ের খোঁজ না পেয়ে বাবা একাই ফিরে যান দেশে।
এ দিকে চম্পাবতী ডাকাতদের কাছ থেকে পালিয়ে একদিন জঙ্গলে পথ হারিয়ে এক ফকিরের দেখা পেলেন। সেই ফকির তাঁকে মেয়ে রুপে পালিত করেন। চম্পাবতীও সাধনা শুরু করেন। প্রায় এক যুগ পর বাবা ওই জঙ্গলে এসে মেয়ের সন্ধান পান। কিন্তু চম্পাবতী তখন রীতিমতো সাধিকা। তাই তিনি আর নিজের দেশের বাড়িতে ফেরেননি। বাবা একা ফিরে যান দেশে। চম্পাবতীর মৃত্যুর পর এই জঙ্গলেই দেহ সমাধিস্থ করে মাজার তৈরি হয়।
সেই মাজার এখন দর্শনীয় স্থান। দু’পাশে মার্বেল পাথরের ফলক লাগানো। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের মানুষ এখানে আসেন। মাজারের সামনে সেগুলি নামিয়ে চম্পা বিবিকে উৎসর্গ করেন। চম্পাকে পীর বলেই মানেন এলাকার মানুষ। বিপদে আপদে তাঁরা মাই চম্পার শরণাপণ্ণ হন। ইলামবাজার হাইস্কুলের ইতিহাস শিক্ষক সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই জঙ্গল এলাকার একটি নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। এখানে পর্যটনের সম্ভাবনা প্রবল। বহু মানুষ এখানে আসেন।”
জঙ্গলের মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে বোলপুর-ইলামবাজার রাস্তা।
চম্পাবতীর মাজার ছাড়া জঙ্গলের অন্যতম আকর্ষণ ৩৮ বর্গ কিমি জুড়ে বনভূমি। শাল, মহুয়া, পিয়াল, আকাশমণি, শিরিষ গাছের ঘন বনে রয়েছে আম, করমজা, চালতা, হরিতকির মতো ফলের গাছও। আগে খয়ের গাছও ছিল, সেই থেকেই জঙ্গলের গ্রামের নাম খয়েরবুনি। নানা পাখিরও আনাগোনা এ অরণ্যে। এই নিসর্গের জন্যই বাংলা ছবির নিয়মিত শ্যুটিং হয় এখানে।
এখানকার নির্জন প্রকৃতিকে ভালো বেসেই মাঝে মাঝেই জঙ্গল লাগোয়া দ্বারোন্দা গ্রামে চলে আসেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তি রতন থিয়াম। সে গ্রামেই নিজস্ব উদ্যোগে থিয়েটার ক্যাম্পাস তৈরি করেছেন বিশ্বভারতীর সংগীতভবনের গবেষক পার্থ গুপ্ত। তিনি বলেন, “জঙ্গলের গ্রামের আদিবাসীদের নিয়ে নাটকের কাজ করছি। সেই উৎসবে বাইরে থেকে এখন প্রতিবার অনেকে আসছেন। সামনের ডিসেম্বরে ন্যাশানাল ট্রাইবাল ফেস্টিভ্যাল হবে গ্রামেই। এবারও রতন থিয়াম আসবেন যোগ দিতে।”
ইলামবাজারের জঙ্গলে এই সেদিনও চুরি-ছিনতাইয়ের খবর থাকলেও, এখন যে বদলে যাচ্ছে বনের চরিত্র বলছেন এলাকার মানুষই। জঙ্গলকে ঘিরে নিত্য গড়ে উঠছে অতিথিশালা। স্থানীয় বাসিন্দা কুমুদরঞ্জন পাল বলেন, “একসময় রোজই সন্ধের পর জঙ্গলের ভিতর চুরির খবর মিলত। যে কারণে পুলিশি পাহারায় রাস্তা পারাপার করত মানুষ। এখন এই জঙ্গল যেমন ইলামবাজারের পর্যটনের মাত্রা বাড়িয়েছে।”
পাশাপাশি এলাকার ১৮টি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের পরিবারের জীবিকা নির্বাহের সংস্থানও করেছে এই জঙ্গল । জঙ্গলের শুকনো পাতা, শুকনো কাঠ যেমন জ্বালানি কাজে লাগে, তেমনি শাল পাতার থালা তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করেন ওই পরিবারের অনেকেই সংসার চালান। উষাদিঘি, লখমিপুর, ধল্লা, মুরগাবনী, নিমবুনি প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দা সাবিত্রী টুডু, রতনী মার্ডি, ছোটেরাম কিস্কুরা জানিয়েছেন, জঙ্গল থেকে খুব বেশি কিছু যে রোজকার হয়, তেমন নয়। তবে, এই জঙ্গলই এলাকার প্রাণ। তবে, এখন কাজের নানা ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
জঙ্গল এলাকায় পর্যটন দফতরের একটি বাংলো ছিল। সেটি মাও হানার আশঙ্কা বন্ধ হয়ে যায়। দফতর সূত্রে খবর, তিন বছর আগে পাঁচটি হরিণ ছাড়া হয়েছিল ওই জঙ্গলে। কিন্তু জঙ্গলটি বোলপুর-ইলামবাজার বাস রাস্তার দু’পাশে হওয়ায় রাস্তায় যানবাহন চাপা পড়ে মারা গিয়েছে ওই হরিণগুলি। জঙ্গলের ডেপুটি রেঞ্জ অফিসার মলয় কুমার ঘোষ বলেন, “বন রক্ষার জন্য ছ’জন স্থায়ী সরকারী কর্মী ছাড়াও ১২টি বন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে গড়ে ৫০ জন যুক্ত রয়েছে। তারা বনের গাছ যাতে চুরি না হয় দেখভাল করে। কোনও চুরি হওয়া গাছ ধরতে পারলে সেই গাছ নিলাম করে প্রতিটি বনকমিটির হাতে ২৫ শতাংশ টাকা তুলে দেওয়া হয়। তবে শুধু টাকাই নয় ওরা জঙ্গলকে ভাল বেসেই রক্ষনাবেক্ষণ করে।”
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বীরভূম’।
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বীরভূম বিভাগ, জেলা দফতর
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।