ফুটবলপ্রেমী স্বামীর জ্বালায় ঘুম উধাও, পঞ্চায়েতে স্ত্রী

কখনও ইস্... কখনও আঃ... কখনও এঃ হে...। কখনও গোওওওওল...। মাস দেড়েক ধরে রাতদুপুরে কচুদার বাড়ির দরজায় কান পাতলে এই সব আওয়াজ ভেসে আসছে। আরও আছে। কলকাতা ময়দানের বাছা বাছা বিশেষণ খলবল করে উঠছে কচুদার জিভের আগায়। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে মজে আছেন বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের রসুনপুরের সর্বাণীশঙ্কর মণ্ডল ওরফে কচুদা।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০৪:৩৫
Share:

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

কখনও ইস্... কখনও আঃ... কখনও এঃ হে...। কখনও গোওওওওল...।

Advertisement

মাস দেড়েক ধরে রাতদুপুরে কচুদার বাড়ির দরজায় কান পাতলে এই সব আওয়াজ ভেসে আসছে। আরও আছে। কলকাতা ময়দানের বাছা বাছা বিশেষণ খলবল করে উঠছে কচুদার জিভের আগায়। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে মজে আছেন বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের রসুনপুরের সর্বাণীশঙ্কর মণ্ডল ওরফে কচুদা।

কিন্তু এ তাঁর একার বাড়ির দৃশ্য নয়। চার বছরে এক বার ফুটবল দেখেন, এমন বাঙালির ঘরেও রাতবিরেতে এই ক’দিন টেলিভিশনের পর্দায় দৌড়ে বেড়িয়েছেন মেসি-স্নেইডার-রবেনরা। সকালে লোকাল ট্রেনের কামরায় উঠলে দেখা যাচ্ছে, রাশি রাশি রাতজাগা ফুটবলপ্রেমিকের ঢুলু ঢুলু চোখ।

Advertisement

তবে কচুদার ব্যাপারটা আলাদা। তাঁর ‘অত্যাচার’ আর নিতে পারছিলেন না কচু-বৌদি। বিশেষ করে, যে রাতে জার্মানির কাছে গো-হারা হারল ব্রাজিল। সাম্বার দেশের কট্টর সমর্থক কচুদা সে দিন চরম হতাশায় ডুবে যেতে যেতে হাত-পা ছুঁড়তে গিয়ে বিছানায় বৌদিকেই কিক মেরে বসেছেন।

মঙ্গলবার রাতের ওই ঘটনার বিহিত চেয়ে পর দিনই স্থানীয় ঢেকা পঞ্চায়েতে হাজির হন কচু-বৌদি ওরফে শঙ্করী। প্রধান মিঠু গড়াইয়ের কাছে নালিশ জানিয়ে বলেন, স্বামীর উৎপাতে রাতের ঘুম উড়েছে। সামান্য জমিতে চাষবাস করে দিন চলে। সেই কাজকম্মও শিকেয়। তার উপরে হাত-পা ছুড়ে ‘হামলা’র ঘটনা।

সব শুনে গম্ভীর থাকার চেষ্টা করেছিলেন মিঠুদেবী। কিন্তু মাঝখানে ফিক করে হেসে ফেলেন। তাতে বছর পঞ্চান্নর শঙ্করী রেগে কাঁই। খেলা চলাকালীন মেন স্যুইচ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন মিঠুদেবী। মনে ধরেনি কচু-বৌদির। পরে গজ গজ করতে করতে বলেন, “আহা কী বুদ্ধি! আমি কি পাখা বন্ধ করে ঘামে সেদ্ধ হব?” মিঠুদেবী বলেন, “অনেকে বাড়ির সমস্যা নিয়ে আসেন বটে, তবে এমন তো কখনও শুনিনি।” বৌদি জানিয়েছেন, শোওয়ার ঘরে টিভি রাখা আছে।

তার রিমোট লুকনো বা কেব্লের তার খুলে রাখার মতো টোটকা প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু কচুকে দমানো যায়নি।

কচু আগে নিজেও খেলতেন। এলাকার লোকজন জানান, খেলোয়াড় হিসেবে নামডাকও ছিল। বয়স বাড়ায় নিজে আজকাল পায়ে বল নিয়ে নামেন না। কিন্তু ষাট বছর পেরনো কচুদার ফুটবল নিয়ে মাতামাতিটা কমেনি। থাকেন ঠাকুরানিপুরে শ্বশুরবাড়িতে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আশপাশে কোথাও ‘ভাই ভাই একাদশ’ বনাম ‘আমরা ক’জন সঙ্ঘ’-র খেলা হচ্ছে জানতে পারলেও ছুটে যান তিনি। মানে, ফুটবল ম্যাচ হলেই হল। কোনও গোল মনে ধরলে এই বয়সেও মাঠে ডিগবাজি খান। স্থানীয় প্রতিবাদ ক্লাবের সম্পাদক কেশব ভাণ্ডারী থেকে এলাকার প্রাক্তন ফুটবলার দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই একবাক্যে বললেন, “কচুদার মতো খেলাপাগল লোক এলাকায় আর দু’টো নেই।”

সে জন্য পাড়ায় খাতিরও কম নয় তাঁর। কিন্তু হলে কী হবে?

নিজের ঘরেই সম্মান নেই। ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায় পঞ্চায়েতে সালিশি চাওয়াটা বাড়াবাড়ি নয়? তবু স্ত্রীর উপরে রাগেননি কচু। বরং সব শুনে সস্নেহে বললেন, “পাগল আর কাকে বলে? ওকে বুঝিয়ে বলেছি, ক’টা দিন সবুর করো। বিশ্বকাপ তো শেষ হয়ে এসেছে।” আনমনা হয়ে মন্তব্য করলেন, “ভাবছি ফাইনাল ম্যাচের আগে একটা হেডফোন কিনে আনব। বিছানা-টিভির মাঝে একখানা পর্দা টাঙালেও মনে হয় পরিবারের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না।”

খেলা দেখতে দেখতে হইচইটা কমাবেন কী করে? শুকনো মুখে কচুদা বললেন, “আর হইচই! ব্রাজিলই হেরে ভূত হয়ে গেল!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন