দু’দিন ধরে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেও পালানোর পথ মেলেনি। হতাশ যুগল শেষমেশ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল। কিন্তু ‘শেষরক্ষা’ হয়নি। যুগলের ভার সইতে পারেনি দড়ি। মাঝপথেই দড়ি ছিঁড়ে জখম হয়ে সেই যুগলের ঠাঁই হয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে!
স্থানীয় সূত্রের খবর, যুগলের বাড়ি পুরুলিয়ার বোরো থানার দুন্দলু গ্রামে। গ্রামে পাশাপাশি দু’পরিবারের চালার বাড়ি। বছর বাইশের তপন সিংহসর্দার রংয়ের কাজ করে। মাসখানেক কলকাতায় কাজ করে গত রবিবারই বাড়ি ফিরেছে। পাশের বাড়ির দশম শ্রেণির মেয়েটির সঙ্গেই তাঁর প্রেমের সম্পর্ক বলে জানা গিয়েছে। সে মেয়ের সঙ্গেই আত্মহত্যা করতে গিয়ে দু’জনেই এখন মানবাজার ২ ব্লকের বসন্তপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি। বুধবার দুপুরে পুলিশ দুন্দলু থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে তামাখুন গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে আহত অবস্থায় দু’জনকে উদ্ধার করে সেখানে ভর্তি করে। এ দিন সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল দু’জনেরই স্যালাইন চলছে। চিকিত্সক অভিজিত্ সিংহ জানান, উঁচু থেকে পড়ে মেয়েটির বাঁ পায়ে জোর আঘাত লেগেছে। এক্স-রে রিপোর্ট বের হলে ভেঙেছে কিনা জানা যাবে। যুবকটির গলায় ব্যাথা রয়েছে। আপাতত দু’জনেই চিকিত্সাধীন থাকবে বলে তিনি জানান। মেয়েটির সম্পর্কিত এক দাদা বলেন, “ভিন্ গাঁয়ের এক ছেলের সঙ্গে বোনের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু ও যে এমন কাণ্ড করে বসবে, আমরা তা ভাবতেও পারিনি।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে শুয়ে মেয়ে অবশ্য তপনের সঙ্গে তার ভালবাসার কথা স্বীকার করে নেয়। তার নিজের কথায়, “আমরা দু’জনে পরস্পরকে ভালবাসি। আমরা বিয়ে করতে চাই। তপন ভিন্ জাতেরর বলে বাড়ির বড়দের তাতে মত ছিল না। উল্টে সম্প্রতি অন্যত্র আমার বিয়ে দেওয়ার কথাও পাকা করে ফেলেছিল। তপনকে সে কথা ফোনে জানাই। তার পরেই আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব বলে স্থির করি।” তার কথাতেই সায় দেয় ওই যুবকও। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই দু’জনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক। বিয়ের খবর পেতেই তাই কলকাতা থেকে সোজা গ্রামে ফিরে পরের দিনই প্রেমিকাকে নিয়ে তিনি বাড়ি ছাড়েন। বিকেল অবধি মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি না ফেরায় তার বাড়ির লোক জন খোঁজ খবর শুরু করেন। যুগলে তত ক্ষণে তামাখুন গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। তপন বলেন, “আমরা ভয়ে জঙ্গল থেকে বাইরে বেরোতে পারছিলাম না। সোম ও মঙ্গলবার দু’রাত জঙ্গলে কাটানোর পরে আমরা বুঝতে পারলাম, বাড়ির লোকের হাতে ধরা পড়লে দু’জনের কপালে দুগর্র্তি আছে। তাই উপায় না পেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিই।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশই জঙ্গলে একটি গাছের তলায় দু’জনকে জখম অবস্থায় দেখতে পেয়ে পুলিশের খবর দিয়েছিলেন। তামাখুন গ্রামের বাসিন্দা ভীম মাহাতো বলেন, “দেখি দু’জনে মাটিতে পড়ে রয়েছে। প্রচুর লোক জন ওদের ঘিরে রয়েছে। মেয়ের বাড়ির লোক জন তপনকে মারধর করছিল। আমরাই ওঁদের নিরস্ত করে থানায় খবর দিই।” এ দিকে, পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় কোনও পক্ষই নিখোঁজ ডায়েরি করেনি। কোনও অভিযোগও জমা পড়েনি। ঘটনায় ক্ষুব্ধ ওই স্কুলছাত্রীর বাবা যদিও এখন বলছেন, “মেয়ে যখন নিজের জীবন নিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমি আর কী করব। তবে, মেয়ের উপর আমার আর কোনও দায় থাকল না।” এ ভাবে দুই দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীর মনোমালিন্যে শোকের ছায়া নেমেছে একাংশের বাসিন্দাদের কাছে। হতাশা ঝরে পড়ল তপনের কাকা বৈদ্যনাথ সিংহসর্দারের গলাতেও। তিনি বলেন, “আমরা দু’ পরিবারই প্রতিবেশী হিসাবে দীর্ঘকাল বাস করছি। এই ঘটনায় খানিকটা হলেও সম্পর্কের অবনতি হল।” তপনের বাবা বাদল সিংহসর্দার অবশ্য যুগলের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তবে, তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “আগে দু’জনকে সুস্থ করে তুলি। মেয়ে এখন থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। ১৮ বছর বয়স হলে ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব। এখন বরং ও পড়াশোনা করুক।”
খানিকটা ঠেকে শিখেছে যুগলেও। মেয়েটি বলছে, “আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক ছিল না। তপন আমাকে কথা দিয়েছে, যতদিন খুশি আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব।”