বোমা বাঁধতে গিয়ে মৃত্যু, দেহ লোপাটের চেষ্টা

এলাকারই এক তৃণমূল কর্মীর বাড়ির পিছনে বসে বোমা বাঁধছিল কিছু দুষ্কৃতী। হঠাৎ বিস্ফোরণ। মৃতদেহ মিলল দু’জনের। তবে, আরও কয়েক জন হতাহত হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি। ঘটনাস্থল বীরভূমের লাভপুর থানার বামনি গ্রাম। বিস্ফোরণস্থল থেকে শেখ বরজাহান ও হাসেম শেখ নামে দুই যুবকের দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃতেরা লাভপুরের বিতর্কিত তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে এলাকা সূত্রে জানা যাচ্ছে।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

লাভপুর শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৭
Share:

লাভপুরের বামনিগ্রামে বোমা বিস্ফোরণে নিহত দুই দুষ্কৃতীর দেহ উদ্ধারে ব্যস্ত পুলিশ।

এলাকারই এক তৃণমূল কর্মীর বাড়ির পিছনে বসে বোমা বাঁধছিল কিছু দুষ্কৃতী। হঠাৎ বিস্ফোরণ। মৃতদেহ মিলল দু’জনের। তবে, আরও কয়েক জন হতাহত হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি।

Advertisement

ঘটনাস্থল বীরভূমের লাভপুর থানার বামনি গ্রাম। বিস্ফোরণস্থল থেকে শেখ বরজাহান ও হাসেম শেখ নামে দুই যুবকের দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃতেরা লাভপুরের বিতর্কিত তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে এলাকা সূত্রে জানা যাচ্ছে। এ দিন ঘটনাস্থলে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় এবং বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রসাদ যাদব। আনন্দবাবু বলেন, “আরও কেউ হতাহত হয়েছে কি না, তা জানতে তল্লাশি চলছে। কী কারণে ওরা বোমা বাঁধছিল তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” বাম নেতাদের দাবি, বিস্ফোরণে মৃতেরা তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী। তৃণমূল তা মানতে নারাজ।

লাভপুরের বামনি গ্রামে বোমা বিস্ফোরণের পরে প্রমাণ লোপাটের জন্য দুষ্কৃতীরা স্থানীয় পুকুরে

Advertisement

তাদের মোটরবাইক ফেলে দিয়েছিল। সেই বাইক উদ্ধার করছে পুলিশ ও জওয়ান।

এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ বামনি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ইসমাইলের বাড়ির পিছনে বিস্ফোরণের চিহ্ন। ওখানেই বোমা বাঁধার কাজ হচ্ছিল বলে গ্রামবাসীরা জানালেন। সেই অংশ দড়ি দিয়ে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ঘটনার পরে দেওয়ালে ছিটকে আসা রক্তের দাগ যে গোবর জল দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল, তা-ও স্পষ্ট। ইসমাইলের বাড়ি থেকে প্রায় একশো ফুট দূরে পুকুর থেকে পুলিশ ও জওয়ানেরা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া টিন, মোটরবাইক উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, দুষ্কৃতীরা সম্ভবত মোটরবাইকে করে এসেছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যেই তা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

মৃতদেহ দু’টি গ্রামের বাইরে থেকে উদ্ধার হয়। তা থেকে পুলিশের অনুমান, দু’টিও লোপাটের চেষ্টা হয়েছিল। ঘটনার পরে গোটা গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য। নাম না প্রকাশ করার শর্তে গ্রামের এক বধূ বললেন, “এক দল লোক মৃতদেহ নিয়ে মাঠের দিকে পালাচ্ছিল। কিন্তু, পুলিশ আসছে বুঝতে পেরে দেহ ফেলে তারা পালায়।” কিছু পুলিশকর্মী জানান, তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেম দরবারপুরের বাসিন্দা বরজাহান তখনও বেঁচে। তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি মোবাইলে এক সিভিক পুলিশকর্মী রেকর্ডও করেন। জবানবন্দিতে বরজাহান দাবি করে, তাকে এবং কাজিপাড়ার হাসেম শেখ-সহ বেশ কয়েক জনকে বোমা বাঁধার জন্য ভাড়া করে এনেছিল ইসমাইলেরই আত্মীয় লালন শেখ।

এখানেই বোমা বাঁধার কাজ চলছিল বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

ইসমাইল, লালনও এলাকার তৃণমূল নেতা আব্দুল মান্নানের অনুগামী হিসাবে পরিচিত। জেলা রাজনীতিতে আব্দুল আবার মনিরুল ইসলামের বিরোধী গোষ্ঠীর। লাভপুর যে লোকসভা কেন্দ্রের আওতায়, সেই বোলপুরের সিপিএম প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ রামচন্দ্র ডোম বলেন, “নির্বাচনের মুখে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। ওদের দলের নেতা মনিরুল ইসলাম যেখানে প্রকাশ্য সভায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করছেন, সেখানে সন্ত্রাস কায়েম করতেই ওই বোমা বাঁধা হচ্ছিল বলে মনে হয়।” তাঁর অভিযোগ, “পঞ্চায়েত ভোটের মতো লোকসভা নির্বাচনকেও প্রহসনে পরিণত করতে চায় তৃণমূল। তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলার পুলিশ সুপার এবং নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি।”

যদিও বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই বলেই দাবি করেছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর অভিযোগ, “ইসমাইলরা ফরওয়ার্ড ব্লকের লোক। আমাদের কর্মীদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যেই ওরা বোমা বাঁধছিল। বিস্ফোরণের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই।” ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক তথা নলহাটির বিধায়ক দীপক চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই এলাকায় তো এখন ফরওয়ার্ড ব্লকের কোনও অস্তিত্বই নেই! তিন বছর আগেও যাঁরা ফব করতেন, তাঁরা এখন তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। এই বিস্ফোরণ ওদেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল।”

এক সময় লাভপুরের বর্তমান বিধায়কও ফরওয়ার্ড ব্লকের দাপুটে নেতা ছিলেন। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে অনুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে সদলবলে তৃণমূলে আসেন স্থানীয় দাঁড়কা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান মনিরুল। তাঁরই নেতৃত্বে তৃণমূলে যোগ দেন ফব-র জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মান্নান এবং বামনি গ্রামের ইসমাইল শেখ, লালন শেখের মতো ফব-র সক্রিয় কর্মীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এর পরেই এলাকার বিভিন্ন কাজের বখরা নিয়ে মনিরুল ও আব্দুলের গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাভপুরে বিনাপ্রতিন্দ্বিতায় তৃণমূল জয়লাভ করার পরে মনিরুলের প্রভাব বাড়ায় সেই বিরোধ বাড়ে।

এ দিন যোগাযোগ করা হলে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মনিরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নান। বিধায়ক বলেন, “কে কার হাত ধরে দলে ঢুকে কী করেছে বলতে পারব না। যা খুশি ধরে নিন।” আর মান্নান বলেন, “কে কবে ফব ছেড়ে তৃণমূলে ঢুকেছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা কেন? আমি বাইরে আছি এর বেশি বলতে পারব না।”

ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন