লাঠি উঁচিয়ে গাড়ি থামিয়ে চাঁদার জুলুম

যান নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তার পাশে রাখা ছিল পুলিশের ব্যারিকেড-বোর্ড। পুজোর চাঁদা তুলতে সেই বোর্ডই রাস্তার উপর তুলে গাড়ি আটকে তোলা হচ্ছে পুজোর চাঁদা। অনেক জায়গায় আবার মোটা বাঁশের লাঠি হাতেই নেমে পড়েছেন চাঁদা সংগ্রহকারীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৩
Share:

পুলিশের যান নিয়ন্ত্রণের বোর্ড দিয়ে গাড়ি আটকানো হচ্ছে রামসাগরে।

যান নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তার পাশে রাখা ছিল পুলিশের ব্যারিকেড-বোর্ড। পুজোর চাঁদা তুলতে সেই বোর্ডই রাস্তার উপর তুলে গাড়ি আটকে তোলা হচ্ছে পুজোর চাঁদা। অনেক জায়গায় আবার মোটা বাঁশের লাঠি হাতেই নেমে পড়েছেন চাঁদা সংগ্রহকারীরা। চাঁদা তোলা নিয়ে এ বারও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন রাস্তায় পরিবহণ কর্মী ও ব্যবসায়ীরা জুলুমবাজির অভিযোগ তুললেও বন্ধ করা যায়নি এই জোরজবরদস্তি।

Advertisement

জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার অবশ্য বলছেন, “জোর করে চাঁদা তোলার অভিযোগ পেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুজো কমিটিগুলিকে আমরা এ বিষয়ে সতর্ক করেছি। এই ধরনের ঘটনা রুখতে সমস্ত থানাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কোথাও কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, রাস্তায় বাস, ট্রাক আটকে চাঁদা তোলার সেই পরিচিত দৃশ্য গত কয়েকদিন আগে আবার ফিরে এসেছে। বাঁকুড়া-মেদিনীপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক, রাজ্য সড়কগুলিতে দিনেদুপুরেই চাঁদা তোলার নামে গায়ের জোর দেখানো চলছে বলে অভিযোগ। চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ির চালক, বাসের কনডাক্টরদের সঙ্গে বচসা বাধছে পুজো কমিটির এই ‘দাদা’দের। মাঝরাস্তায় গাড়ি থমিয়েই চলছে বাদানুবাদ। এই কাঠফাটা গরমের মধ্যে ভিড়ে ঠাসা বাসে আটকে পড়ে যাত্রীরাও বিরক্ত হচ্ছেন। রাস্তায় পাকিয়ে উঠছে যানজট। কিন্তু এ সব জেনেও সে ভাবে পুলিশকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যাচ্ছে না বলে যাত্রীদের অভিযোগ।

Advertisement

ফি’বছর পুজো মরসুমেই এটাই যেন রেওয়াজ হয়ে উঠেছে বিশেষত বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর রাস্তায়। বাঁকুড়া শহরের কেরানিবাঁধ, বাইপাস এলাকার রাস্তায় বাস আটকে চাঁদা তুলতে দেখা যাচ্ছে অফিস টাইমেই। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে ওন্দার রামসাগরে ভোরের দিকে লাঠি হাতে লোকজন বাস, ট্রাক আটকাচ্ছে। দিনের আলো একটু চড়া হলেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে তারা।

হাতে চাঁদার বিলবই, সঙ্গে লাঠি। বিষ্ণুপুরের নেতাজিনগরে
এই দৃশ্য ভয় ধরিয়েছে পরিবহণ কর্মীদের। ছবিগুলি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।

এই সড়কেই বিষ্ণুপুর থানার বৈতলমোড় এলাকায় ক’দিন আগে একদল স্থানীয় যুবককে গাড়ি আটকে চাঁদা তুলতে দেখা গেল। তাদের দাপটে একের পর এক ট্রাক সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে যেতেই অমনি চাঁদার রসিদ বই পকেটে ঢুকিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল ট্রাকগুলিকে। পরে টিপ্পনির সুরে প্রশ্ন, ‘‘ভাল কাজের তো কেউ ছবি তুলছেন না?” পাল্টা প্রশ্ন, এ ভাবে চাঁদা তোলা কি ঠিক কাজ? জবাব এলো— “আপনাদের কীসের সমস্যা?”

বাঁকুড়া জেলা বাসমালিক সমিতির কর্তাদের অভিযোগ, বাঁকুড়া থেকে দুর্গাপুর, শালতোড়া, পুরুলিয়া, আরামবাগ, সোমামুখী, বর্ধমান যাওয়ার রাস্তাগুলিতে বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি আটকে দলে দলে চাঁদা তোলা হচ্ছে। জোর করে কোথাও কোথাও ২০০-২৫০ টাকার চাঁদার রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের দাবি, দাবি মতো চাঁদা দিতে না চাইলে উল্টে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। জেলা বাসমালিক সমিতির সম্পাদক দীপক সুকুল বলেন, “প্রতি বছরের মতো এ বারও বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকে দুর্গাপুজোর জন্য রাস্তায় গাড়ি আটকে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে। চলবে কালী পুজো পর্যন্ত। বাসকর্মীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন কড়া হলে এ সব ঠেকানো যেত।”

তারকেশ্বর-বাঁকুড়া এবং বাঁকুড়া-দুর্গাপুর রুটে দীপকবাবুর দু’টি বাস চলে। তাঁর অভিযোগ, গত বছর পুজো মরসুমে এই দু’টি রুটে বিভিন্ন পুজো কমিটিকে প্রায় তিন হাজার টাকা চাঁদা মেটাতে হয়েছি তাঁকে। এ বছর চাঁদার মোট অঙ্ক আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। গতবছর বাঁকুড়া চেম্বার অফ কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক মধূসুদন দরিপার ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত একটি গাড়িকে দাবি মতো চাঁদা না দেওয়ায় সোনামুখীর রামপুর একালায় আটকে রেখেছিল চাঁদা সংগ্রহকারীরা। মধুসূদনবাবু বলেন, “আমার গাড়ি আটকে রেখে চালককে মারধরও করা হয়েছিল চাঁদার জন্য। খবর পেয়ে আমি স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধিকে ফোন করে ঘটনার কথা জানালে তিনি কোনও রকম সাহায্য করতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। পরে জেলার পুলিশ কর্তাদের ঘটনাটি জানালে স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মীরা গিয়ে গাড়িটি উদ্ধার করেন।” তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক মদত না থাকলে এ ভাবে বেআইনি কাজ করা যায় না। প্রতি বছর পুজোর সময় এলেই এই ধরনের জুলুমবাজি বেড়ে যায়।

চাঁদার জুলুম রুখতে পুলিশের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। পুলিশ একটু সক্রিয় হলেই বেআইনি এই কাজ রোখা যাবে বলেও মত অনেকের। মধুসূদনবাবু বলেন, “কিছুদিন আগে বাঁকুড়া শহরের লালবাজারে আইন ভেঙে মাইক বাজানোর ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাঁকুড়া সদর থানার আইসি। ওই ঘটনার পর দেখলাম বিশ্বকর্মাপুজোতেও মাইক বাজানোয় অনেকটাই লাগাম টেনেছেন পুজো কর্তারা। একই রকম কড়া পদক্ষেপ রাস্তা আটকে চাঁদা তোলার ক্ষেত্রেও পুলিশ নিক।” পরিবহণ কর্মীরাও জানাচ্ছেন, চাঁদার জুলুম রুখতে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করুক। তা না হলে এই সময়ে রাস্তায় গাড়ি বের করতে ভয় লাগে। একমাত্র পুলিশ সক্রিয় হলে চাঁদার জুলুম বন্ধ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন