সমবায় ব্যাঙ্কে অচলাবস্থা চলছেই

লেনদেন বন্ধে শঙ্কায় এজেন্টরা, সাময়িক বেতন বন্ধ কর্মীদেরও

দৃশ্য ১: ভোর সাড়ে ৫টা। নলহাটির পাহাড়ি গ্রাম। এক সাইকেল চালক বাড়ি বাড়ি পৌঁছে ছোট কাগজের স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছেন। স্থানীয় বাহাদুরপুর পাথর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের একটা বড় অংশের আয়ের টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার জন্য দীর্ঘ দিন শীত-গ্রীষ্ণ-বর্ষা প্রতি দিন ওই সাইকেলওয়ালা সংগ্রহ করে নিয়ে যান।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০০:৪২
Share:

দৃশ্য ১: ভোর সাড়ে ৫টা। নলহাটির পাহাড়ি গ্রাম। এক সাইকেল চালক বাড়ি বাড়ি পৌঁছে ছোট কাগজের স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছেন। স্থানীয় বাহাদুরপুর পাথর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের একটা বড় অংশের আয়ের টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার জন্য দীর্ঘ দিন শীত-গ্রীষ্ণ-বর্ষা প্রতি দিন ওই সাইকেলওয়ালা সংগ্রহ করে নিয়ে যান।

Advertisement

দৃশ্য ২: রামপুরহাট পাঁচমাথা মোড়। রাত সাড়ে ন’টা অবধি রোজ সাইকেল চালিয়ে এক ব্যক্তি দোকানে দোকানে ঘুরে সঞ্চয়ের টাকা সংগ্রহ করছেন। পরের দিনই সেই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে।

উপরের দৃশ্য দু’টি নমুনা মাত্র। জেলা জুড়ে ‘বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যঙ্কে’র ১৭টি শাখার ‘মিনি ডিপোজিট স্কিমে’র কয়েক শ’ কর্মী দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্যাঙ্কের হয়ে এজেন্টের কাজ করছেন। নতুন অ্যাকাউন্ট খোলানোর পাশাপাশি প্রতি দিন নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে চাষি, শ্রমিক, দিন মজুর সবার কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে তাঁদের সঞ্চয় ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে গিয়েছেন ওই এজেন্টরা। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই গ্রাহকদের পাশাপাশি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে ব্যাঙ্কের অধীন অস্থায়ী ভাবে মাসিক কমিশনের ভিত্তিতে কর্মরত ওই শতাধিক এজেন্টের। সঞ্চিত টাকা ফেরত পেতে রোজদিন গ্রাহকেরা তাঁদের কাছে ভিড় করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সম্মানহানির ঘটনাও ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে কাজ হারানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত্‌ ভাবনায় চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ওই সব এজেন্টরা।

Advertisement

তবে, কেবল ওই এজেন্টরাই নন, লেনদেন বন্ধে কোপ পড়েছে ১৭টি শাখার সঙ্গে বিভিন্ন কাজে যুক্ত আরও হাজার খানেক অস্থায়ী। এমনকী, ঘটনা হল ব্যাঙ্কের লেনদেন বন্ধের জেরে গত মাসের বেতন পাননি প্রায় ৮০ জন স্থায়ী কর্মীও। ঘটনার সত্যতা মেনে নিয়ে ব্যাঙ্কের বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলছেন, “ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখা মিলিয়ে প্রায় ৮০ জন স্থায়ী কর্মীর বেতন সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়েছে। কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করেন, এমন বহু অস্থায়ী কর্মীও কাজ হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন। তবে, বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। খুব শীঘ্রই ব্যাঙ্কের অচলাবস্থা কেটে যাবে।”

ব্যাঙ্ক সূত্রে খবর, ওই মিনি ডিপোজিট স্কিমে সঞ্চয়ের টাকা সংগ্রহ করাই ওই এজেন্টদের মূল কাজ। তার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে তাঁরা একশো টাকায় ১ টাকা ৭৫ পয়সার হিসেবে কমিশন পান। এ ছাড়াও স্বল্প কমিশনের ভিত্তিতে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলানোর কাজও তাঁরা করতেন। যদিও ২০১২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিষাধাজ্ঞার জেরে তা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ওই এজেন্টরা ওই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। ১৭টি শাখার প্রতিটিতে কম করে ১০ জন করে এজেন্ট আছেন। ওই এজেন্টদের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে। ওই এজেন্টরা দীর্ঘ দিন ধরে নিজেদের স্থায়ী করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক সেই দাবি মেনে নেয়নি। ব্যাঙ্কের এই বেকায়দার দিনে তাঁদের অবস্থা আরও করুণ। ব্যাঙ্কের এজেন্ট হয়ে কাজ করার পাশাপাশি অনেকেই ওই ব্যাঙ্কেই খাতা খুলে ছিলেন। ফলে অন্যান্য গ্রাহকদের মতোই তাঁরাও পরিশ্রম করে নিজেদের জমানো টাকার কিছুই তুলতে পারছেন না। নলহাটি শাখার এক এজেন্ট যেমন মেয়ের বিয়ের জন্য সঞ্চিত টাকা তুলতে পারছে না, তেমনই বোলপুর শাখার এক এজেন্ট আবার নিজের চিকিত্‌সার জন্যও টাকা তুলতে পারছেন না।

১৯৮৮ সাল থেকে ব্যাঙ্কের এজেন্টের কাজ করছেন রামপুরহাটের বড়শাল গ্রামের কুশল মুখোপাধ্যায়। ৫৭ বছরের ওই প্রৌঢ়ের অভিযোগ, “ব্যাঙ্ক এজেন্টদের উপযুক্ত কমিশন তো দেয়ইনি। উল্টে এমন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে পেট আর পিঠ, দু’টোই বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। গ্রাহকদের টাকা আর আমাদের সম্মান টিকিয়ে রাখাটাই এখন আমাদের মূল লড়াই।” আর এক এজেন্ট অসিত মুখোপাধ্যায় জানান, মিনি ডিপোজিট স্কিমে ‘ডেলি অ্যাকাউন্ট’ এজেন্ট হিসেবে প্রায় জন দেড়শো জন অস্থায়ী, ব্যাঙ্কের শাখাগুলিতে স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ১৪০ জন কর্মী আছে। এ ছাড়া ব্যাঙ্কের অধীন সাড়ে তিনশো কৃষি সমবায় উন্নয়ন সমিতি আছে। তাঁর দাবি, সেখানে প্রায় হাজারখানেক কর্মী ব্যাঙ্কের এই অচলাবস্থার জেরে বিপাকে পড়েছেন। অসিতবাবুর কথায়, “রোজগারহীন অবস্থায় দিন গুজরান করছি। ব্যাঙ্কে লেনদেন বন্ধের দিন যত বাড়ছে, আমাদের উপরে তত চাপ তৈরি হচ্ছে।” রাজ্য সরকার দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করবেন বলেই তাঁর আশা।

ওই এজেন্টদের তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের সম্পাদক পার্থ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, রাজ্য সরকার বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখে ব্যাঙ্কের এই দুরবস্থা কাটানোর চেষ্টা করবেন। সেই মতো তাঁদের সংগঠন জেলা তৃণমূল নেতৃত্বর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। ব্যাঙ্কের স্থায়ী কর্মীরা অবশ্য এই অচলাবস্থা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে, ব্যাঙ্কের আগের চেয়ারম্যান তথা জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী এবং তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, দু’জনেই পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে বলে দাবি করেছেন। অন্য দিকে, ব্যাঙ্কের এআরসিএস (অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভ সোসাইটিস) সৌগত সেনগুপ্ত বলেন, “উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। উপর মহলে আলোচনা চালাচ্ছেন। দেখা যাক কী হয়।”

সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে রাজ্য সরকার যদি অবিলম্বে সমস্যা মেটাতে পদক্ষেপ না করে, তা হলে বীরভূমের কয়েক দশকের পুরনো সমবায় আন্দোলনের সলিলসমাধি ঘটতে বেশি সময় লাগবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন