শিল্প ছেড়ে ভরসা এখন খুচরো ব্যবসা

মুরারই থেকে ঝাড়খণ্ড সীমান্তের দূরত্ব সড়ক পথে ৮ কিলোমিটার। আর ট্রেনে সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে মুরারই স্টেশনের দুটি স্টেশন পরেই ঝাড়খণ্ড। অন্য দিকে দশ-বারো কিলোমিটারের মধ্যে মুর্শিদাবাদ। যোগাযোগের এই সুবিধা সত্ত্বেও মুরারইয়ে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন শিল্প। এলাকার জীবন ও জীবিকার ভরসা বলতে এখন তাই টিমেটিমে কতগুলি খুচরো ব্যবসা।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

মুরারই শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৪৪
Share:

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মুরারইয়ের একটি বিস্কুট কারখানা। —নিজস্ব চিত্র

মুরারই থেকে ঝাড়খণ্ড সীমান্তের দূরত্ব সড়ক পথে ৮ কিলোমিটার। আর ট্রেনে সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে মুরারই স্টেশনের দুটি স্টেশন পরেই ঝাড়খণ্ড। অন্য দিকে দশ-বারো কিলোমিটারের মধ্যে মুর্শিদাবাদ। যোগাযোগের এই সুবিধা সত্ত্বেও মুরারইয়ে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন শিল্প। এলাকার জীবন ও জীবিকার ভরসা বলতে এখন তাই টিমেটিমে কতগুলি খুচরো ব্যবসা।

Advertisement

মুরারইয়ে কেন এমন ব্যবসা ক্ষেত্রের পট পরিবর্তন? এক একটি শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক একরকম কারণ বলছেন এলাকার মানুষ। সে সব শুনতে শুনতেই বিস্ময় জাগে, এত ধরণের শিল্প ছিল একটি গঞ্জে! এখন যার প্রায় কিছুই নেই।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি মুরারই রেলস্টেশন লাগোয়া এলাকায় একসময় মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান, সামসেরগঞ্জ, লালগোলা, রঘুনাথগঞ্জ এলাকার পাট বিক্রির আড়ত ছিল। মুরারইয়ের এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন সে কথা। জানা গেল, স্টেশন রেলগেট লাগোয়া এলাকায় কুঠিবাড়ির পাটের আড়ত থেকে ট্রেন যোগাযোগে হুগলি, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা এলাকার বিভিন্ন জুট মিলে পাটের যোগান যেত। ঘটনা হল, নানান সঙ্কটে জর্জরিত একের পর এক জুট মিল যখন বন্ধ হতে থাকে তখন থেকেই এলাকার পাটের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। এবং ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক চালু হওয়ার পর মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে কলকাতা সন্নিহিত জেলাগুলির যোগাযোগ ভালো হওয়ার পাটের আড়তদারি ব্যবসাগুলিও বন্ধ হয়ে যায়।

Advertisement

এখনও মুরারই স্টেশনে রেলগেট লাগোয়া কুঠিবাড়ি সেই জায়গাতেই রয়েছে। তবে এখন তার সামনে ফল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্যান্য খুচরো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। এলাকায় পরিচিত এমন আর একটি ব্যবসা কেন্দ্রও এখন জৌলুস হারিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা যাকে বেগুন মোড় বলেন, সেই মোড়ে এক সময় বাঁশলৈ, মুরারই লাগোয়া এলাকা-সহ ঝাড়খণ্ড ও মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানা, রঘুনাথগঞ্জ থানার উৎপাদিত বেগুন বিক্রি হত। এলাকার ভিতর দিয়ে মুরারই গ্রামীণ হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তার সঙ্গে যেখানে বাইপাস মিশেছে সেই সংযোগ স্থলের বেগুন মোড় থেকেই একসময় এলাকার বেগুন যেত কলকাতার শিয়ালদহর হাটে। এখনও বেগুনের হাট বসে একানে। কিন্তু এখন আর সেই কারবার নেই। স্থানীয়রা বলছেন, এখন চাষীদের বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের দিকে নজর চলে যাওয়ার জন্য বেগুনের উৎপাদন হয় না। বেগুনের সেই বড় বাজারের মহল্লাই এখন বদলে গিয়েছে ছোট হাটে।

বন্ধ শিল্পগুলির তালিকা দীর্ঘ। ৩১ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে এলাকার দুটি রাইস মিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিস্কুট কারখানা। বন্ধ হয়ে যাওয়া রাইস মিল চত্ত্বরে এখন মুরারই হাট বসে। এলাকার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পান্নালাল দত্ত জানান, “আজ থেকে ৮০ বছর আগে আমরা আমোদপুর থেকে ব্যবসা করার জন্য মুরারই এসেছিলাম। ১৯৩৬ সালে সেই সূত্রে মুর্শিদাবাদ জেলার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রাইস মিল কেনা হয়। তখনকার দিনে তুষের আগুনের মাধ্যমে স্টিম ইঞ্জিন চালিয়ে রাইস মিল চলত। ৭১ সালে মুরারই এলাকায় বিদ্যুৎ এল। তিনি বলেন, “তারও দশ বছর আগে থেকে সরকার যখন রাইস মিলের উপর লেভি প্রথা চালু করে। প্রায় তখন থেকে বীরভূমের প্রায় প্রত্যেকটি রাইস মিল ধুঁকতে শুরু করে।”

ঘটনা হল, রুগ্ণ অবস্থা কাটাতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয় বিভিন্ন রাইস মিলে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে হাসকিং মিলের অনুমোদন দেওয়ার জন্য ৮৩ সালে রাইস মিল তুলে দিতে বাধ্য হন অনেক শিল্পপতি।

দুটি রাইস মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বহু শ্রমিক কাজ থেকে বঞ্চিত হন। পান্নালালবাবুদের বিস্কুটের কারখানাও ছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেই কারখানা। ফলে কাজ হারিয়েছেন সেই কারখানার শ্রমিকরাও। একসময় কলকাতা থেকে যে সব কেমিষ্ট বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কর্মীরা মুরারইয়ের মতো গ্রামীণ এলাকায় এসে কারখানায় কাজ করতেন, আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁদেরও। এছাড়া এখানেই ছিল চানাচুর কারখানা, তেল মিল। সে সবও বন্ধ এখন।

এভাবেই উৎপাদনমূলক ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে মুরারইয়ের বাজার অর্থনীতি এখন খুচরো ব্যবসার উপর টিকে আছে। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুরারই এলাকার ব্যবসায়ীদের দিলীপ পিপাড়া, অরিণ দত্তরা বলছেন, মুরারই এলাকার ব্যবসা করার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মুরারই স্টেশনের রেলগেট। মুরারই স্টেশনে ফুট ওভার ব্রিজ থাকলেও রাজগ্রাম পাথর শিল্পাঞ্চল এলাকার পাথর বোঝাই গাড়ি, কয়লা গাড়ি, বালির গাড়ি মুরারই এলাকার উন্নয়নকে স্তব্ধ করে রেখেছে।

রেলগেট পড়ে থাকলে একদিকে মুরারই-রাজগ্রাম রাস্তা অন্যদিকে মুরারই-রঘুনাথগঞ্জ রাস্তা যানজটে নাগরিক জীবন অতিষ্ট হয়ে যায়। এর জন্যই মুরারই এলাকায় যে কোনও পণ্য বোঝাই করতে ট্রাক মালিকরা নলহাটি থেকে পাঁচশ থেকে হাজার টাকা বেশি নেয়। অন্য দিকে বাঁশলৈ যাওয়ার জন্য বাইপাস রাস্তা নির্মাণের জন্য জমির মাফজোক এখনও শেষ হয়নি। এর ফলে ওই বাইপাস রাস্তা আজও নির্মাণ হয়নি। এর ফলে নিত্যদিনের যানজটের সমস্যায় আজও মুরারইবাসীকে ভুগতে হচ্ছে।

বড় শিল্পগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেমন এলাকার মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী বলছেন প্রশাসন?

এসডিও উমাশঙ্কর এস বলেন, “উদ্যোগপতিরা যদি আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে ভাবনা চিন্তা করব কি করে ওই সব বন্ধ ব্যবসা নতুন করে খোলা যায় সে নিয়ে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন