শিশু দিবসের পরেই মিস্ত্রির কাজে রাজকোট যাচ্ছে ভালু, ধনঞ্জয়রা

স্কুল ছাড়িয়ে ভাইকে কাজে পাঠাল দাদা

রাজস্থানের জয়পুরে এই জেলারই পাচার হয়ে যাওয়া ১৩ জন শিশু শ্রমিকের কাজের নামে অমানুষিক অত্যাচারের ঘটনা সদ্য প্রকাশ্যে এসেছে। সেখান থেকে অসুস্থ হয়ে পড়া এক শিশু শ্রমিকের ফেরার পথে ট্রেনে মৃত্যুর ঘটনা অনেকের মন নাড়িয়ে দিয়েছে।

Advertisement

সমীর দত্ত

মানবাজার শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫৪
Share:

রাজস্থানের জয়পুরে এই জেলারই পাচার হয়ে যাওয়া ১৩ জন শিশু শ্রমিকের কাজের নামে অমানুষিক অত্যাচারের ঘটনা সদ্য প্রকাশ্যে এসেছে। সেখান থেকে অসুস্থ হয়ে পড়া এক শিশু শ্রমিকের ফেরার পথে ট্রেনে মৃত্যুর ঘটনা অনেকের মন নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার জেরা কাটতে না কাটতেই শিশু দিবসের পরের দিন কাল শনিবার সেই মানবাজারেরই দু’জনকে শিশু শ্রমিকের কাজ করতে পাঠানো হচ্ছে রাজকোটে।

Advertisement

কেন? প্রশাসনের আধিকারিক থেকে সমাজের বিভিন্নমহলের মানুষজনের মত, দারিদ্রই এর প্রধান কারণ। শিশু শ্রমিক বন্ধের জন্য আইন তৈরি করে কিংবা নানা প্রকল্প চালু করেও গরীব বাড়ির ছেলেদের স্কুলে ধরে রাখা যাচ্ছে না। পেটের দায়ে তাই বাবা ছেলেকে ভিন্‌ রাজ্যে কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজের নিচুস্তর পর্যন্ত উন্নয়নের ধারা না গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত শিশু শ্রম বন্ধ করা যাবে না।

মানবাজার থানার কাশিডি ও বোরো থানার ওলগাড়া গ্রাম থেকে ১৩ জন শিশু শ্রমিককে কলকাতায় গেঞ্জি কারখানায় কাজ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে মাস পাঁচেক আগে রাজস্থানের জয়পুরে জরির কারখানায় পাচার করা হয় বলে অভিযোগ। সম্প্রতি নিতাই শবর নামে অসুস্থ এক শিশু শ্রমিক সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনেই মারা যায়। খবর পেয়েও টাকার অভাবে পরিবারের লোকেরা তার মৃতদেহ বাড়িতে আনতে পারেননি। ওই ঘটনার পরেই জানা যায়, তাদের জয়পুরে আটকে রেখে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হাড়ভাঙা খাটানো হচ্ছে।

Advertisement

ওলগাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুষেণ শবরের বড় ছেলেও ওখানে আটকে রয়েছে। সুষেণবাবু বলেন, “জমিজমা নেই। লোকের জমিতে কাজ পেলে তবে ভাতের সংস্থান হয়। তাই বড়ছেলেকে গ্রামের ছ’জনের সঙ্গে কলকাতায় কাজ করতে পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ওখানে রোজগার যেমন করতে পারবে, তেমন নিজের খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারবে। এখন জানতে পাচ্ছি ওদের জয়পুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব অত্যাচার করছে বলেও শুনেছি। জানি না ছেলেটা কেমন আছে।”

এই মানবাজারেরই তামাখুন গ্রামের ভালু শবর ও ধনঞ্জয় শবর দু’জনের বয়স ১৫। শনিবার দু’জনকে রাজমিস্ত্রীর কাজে রাজকোটে পাঠানো হচ্ছে। ভালুর বাবা পাকা শবরের কথায়, “এখানে থেকে ছেলেগুলো করবে কী? বাইরে থাকলে নিজের পেট চলবে, কিছু টাকাও তো আনতে পারবে।” এলাকার বাসিন্দারা জানান, ভালু এবং ধনঞ্জয়ের সাথে বরাবাজার থানার জাহানাবাদ থেকে আরও তিন থেকে পাঁচজন শিশু শ্রমিকের সেখানে কাজ করতে যাওয়ার কথা। বোরো থানা এলাকার এক ব্যক্তি ওঁদের নিয়ে যাচ্ছেন।

মানবাজারের কাশিডি গ্রামের শবরপাড়ায় একটি বেসরকারি স্কুল চালান এক সাধু। তাঁর আক্ষেপ, “বোরো থানার তামাখুন গ্রামের এক কিশোর বিকাশ শবর এই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। সম্প্রতি তার দাদা আকাল শবর তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে ভিন্‌ রাজ্যে কাজে পাঠিয়ে দিয়েছে।” কেন? আকালের যুক্তি, “পড়াশোনা করে সময় নষ্ট না করে বিকাশ কাজ শিখুক। সে জন্যই ওকে বাইরে পাঠিয়েছি।” তিনি আর কথা বাড়াতে নারাজ।

শবর খেড়িয়াদের উন্নয়নের দাবি নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যান সমিতি’ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। সমিতির অন্যতম কর্তা প্রশান্ত রক্ষিতের আক্ষেপ, “আইন থাকলেও শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। দারিদ্র্যের কারণে শিশুশ্রম সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে আছে।” তিনি দাবি করেন, সমিতির নিজস্ব উদ্যোগে জেলার চারটি ব্লকে ২০টি স্কুল চলছে। আদতে এই সব শিশুদের স্কুলমুখি করতে এই উদ্যোগ। তাঁর অভিযোগ, সরকারিস্তরে শিশু শ্রমিক বন্ধে উদ্যোগ সে ভাবে নজরে পড়ে না। চাইল্ড লাইনের পুরুলিয়া জেলার কো-অর্ডিনেটর দীপঙ্কর সরকার পাল্টা দাবি করেন, “নাবালিকা বিয়ে বন্ধের পাশাপাশি আমরা শিশুশ্রম বন্ধেও উদ্যোগী। বিভিন্ন দোকানে কাজ করা শিশুদের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।”

তবে শিশু শ্রম যে বন্ধ করা যায়নি, শিশু দিবসের আগের দিন বৃহস্পতিবার তা মেনে নিয়েছেন জেলার শ্রম কমিশনার মনোজ সাহা। তিনি বলেন, “আমাদের তেমন পরিকাঠামো নেই। জেলায় ২৪ জন লেবার ইন্সপেক্টর থাকার কথা, সেখানে মাত্র ১১ জন রয়েছেন। কোথায় কতজন শিশু শ্রমিক হিসেবে ভিন্‌ রাজ্যে যাচ্ছে, আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তাই কোথাও শিশু শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় পড়লে আমাদের খুব বেকায়দায় পড়তে হয়।”

প্রশান্তবাবু বলেন, “শিশু শ্রমিক পাচার এক লাভজনক ব্যবসা। স্থানীয় স্তরের এজেন্ট কমিশনের লোভে এদের পাচার করে। সম্প্রতি যে দলটি জয়পুরে কাজ করতে গিয়েছে ফেরত আসা এক কিশোর শ্রমিক জানিয়েছে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হতো। যার জেরে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।” শিশু শ্রমিকদের সম্পর্কে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও প্রশাসনের কর্তাদের মতে, শুধু আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। শিশুশ্রম বন্ধে দারিদ্রই এখনও প্রধান বাধা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন