প্রাক্তন ও বর্তমান। বোলপুরে ফল প্রকাশের পরে রামচন্দ্র ডোম ও অনুপম হাজরা। ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।
গত লোকসভা ভোটেই অশনিসঙ্কেত দেখা দিয়েছিল। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে কার্যত ধস নামে। এ বার তৃণমূলের দাপটে পুরোপুরি ধুলিসাত্ হয়ে গেল বামেদের লালদুর্গ বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র। জয়ের পরে দলীয় কর্মীদের হাতে আবির মাখতে মাখতে তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরা বললেন, “জন্ম থেকেই দেখছি সিপিএম! একটা জগদ্দল পাথরের মতো এই কেন্দ্রে বসে ছিল। ওই দলটাকে এখান থেকে সরাতে পেরে ভাল লাগছে। দিদির উন্নয়নের জন্যই জনগণ আমাকে জেতালেন।”
নির্বাচনী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছেন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা সিপিআই নেতা দুর্গা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রয়াত জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীহার দত্ত, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুনীতি চট্টরাজ প্রমুখ। একমাত্র ১৯৬৭ সালেই ওই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ফুলরেণু গুহকে হারিয়ে ফের বোলপুরের দখল নেয় সিপিএম। এরপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে ওই কেন্দ্রে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে সিপিএম। কিন্তু ২০০৯ সালের ভোটেই ব্যবধান কমে যায়। তৃণমূল ও কংগ্রেস জোটের প্রার্থী অসিত মালকে ১ লক্ষের কিছু বেশি ভোটে হারান সিপিএমের রামচন্দ্র ডোম। অথচ তার আগের বারই বামেদের জয়ের ব্যবধান ছিল ৩ লক্ষেরও বেশি। ৬৫.৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল পেয়েছিল ১,৯৪,৫৩১টি ভোট। সেখানে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে রামচন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী অসিত মাল পান ৪ লক্ষেরও বেশি ভোট। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বামফ্রন্টের ভোট-ব্যাঙ্কে ভাঙন শুরু হয় তখন থেকেই। ২০১১ সালের বিধানসভার ফলাফলের নিরিখে তা এক ধাক্কায় আরও কমে যায়। তখন থেকেই অশনিসঙ্কেত দেখছিল সিপিএম।
এ দিন কার্যত ভোর থেকেই বোলপুর কলেজের গণনাকেন্দ্রের সামনে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নির্বাচনী এজেন্টরা হতে শুরু করেন। চার চাকা গাড়ি, মোটরবাইক এবং সাইকেলে লাগানো দলীয় পতাকা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা অধিকাংশই তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএমের উপস্থিতি চোখে পড়েনি বললেই চলে। সকাল ৭টা ২৫ নাগাদ গণনাকেন্দ্রে পৌঁছে যান সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। গণনা কেন্দ্রে থাকা কর্মী-সমর্থকদের আস্বস্ত করেন। তার পরেই একে একে গণনাকেন্দ্রে পৌঁছন বিজেপি প্রার্থী কামিনীমোহন সরকার এবং তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরা। কংগ্রেস প্রার্থী তপন সাহার অবশ্য গণনাকেন্দ্রে দেখা মেলেনি।
কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মহকুমা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যেই গণনাকেন্দ্রের কাছে যাওয়া যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সকাল ৮টার পরে পোস্টাল ব্যালট গণনা শুরু হয়। প্রথম দিকে একবার সিপিএম প্রার্থীর এগিয়ে যাওয়ার খবরের রটনায় খানিকটা হলেও কিছু ক্ষণের জন্য মুশড়ে পড়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। সঠিক খবর মিলতেই মুখে হাসি ফুটল অনুব্রতর। ষষ্ঠ রাউন্ড গণনা শেষে সিপিএম প্রার্থীর থেকে প্রায় তেরো হাজার ভোটে তৃণমূলের অনুপম হাজরার এগিয়ে থাকা মাইকে ঘোষণা করা হয়। পরের রাউন্ডগুলিতে সেই ব্যবধান ক্রমশ বাড়তেই থাকে। দুপুর ১২টা নাগাদই গণনাকেন্দ্র লাগোয়া এলাকায় সবুজ আবিরে মেতে ওঠেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। ২১ রাউন্ড ভোট গণনার প্রত্যেকটিতেই এগিয়ে ছিলেন অনুপম।
১৮ রাউন্ড গণনার মাঝেই গণনা কেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে যান রামচন্দ্র ডোম। গেটের মুখেই তাঁকে জড়িয়ে ধরেন তৃণমূল প্রার্থী। দু’জনে হাত মেলান। বাইরে বেরিয়ে নিজের পরাজয় মেনে নিয়েও রামচন্দ্রবাবু বলেন, “এই অন্যায় যুদ্ধে দুর্বৃত্তের জয় হয়েছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন এই ভোটে ঘটেনি। বুথ দখল, ছাপ্পা, রিগিং করে ভোট হয়েছে। এর দায় নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য প্রশাসনকেই নিতে হবে।” তবে উন্নয়নের স্বার্থে জয়ী সাংসদকে সব সময় সহযোগিতা করার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন।
বস্তুত, শুধু তৃণমূলই নয়, এই পরাজয় যে অবশ্যম্ভাবী তা বুঝতে পারছিলেন সিপিএমের একাংশও। কারণ ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের হিসেবেই সিপিএম ও বিরোধীদের মধ্যে লোকসভা ভিত্তিক ব্যবধান কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৬৪৭টি ভোটে। পরবর্তী কালে যোগ হয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সাফল্য। জেলার অধিকাংশ পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিই নয়, একক ভাবে জেলা পরিষদও দখল করে তৃণমূল। নানুর, বোলপুর, ইলামবাজার, লাভপুর-সহ বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দল প্রার্থীও দিতে পারেনি। এ বারের লোকসভা নির্বাচনেও বোলপুর কেন্দ্রের বহু বুথে তৃণমূলের বাধায় বিরোধীরা এজেন্ট বসাতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছিল। তখন থেকেই বাম প্রার্থীর হারাটা প্রায় নিশ্চিত ছিল বলে দাবি তৃণমূলের। শুধু ঘোষণাটুকুই বাকি ছিল। এ দিন রাত ৯টার পরে সরকারি ভাবে অনুপম হাজরার সেই জয় ঘোষিত হওয়ার পরে বামেদের কফিনে শেষ পেরেকটিও ঢুকে গেল।
কর্মী-সমর্থকদের উল্লাসের মাঝে তৃণমূলের নতুন সাংসদ বললেন, “জনগণই আমাকে জিতিয়েছেন। জনগণের কথা সব সময় মাথায় থাকবে। ওঁদের জন্যই কাজ করব।”
এ দিকে, বহু দিন পরে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরবেন পুলিশ কর্মীরাও। গণনা কেন্দ্রের তদারকি শেষে জেলা পুলিশের এক কর্তা কপালের ঘাম মুছে বললেন, “নির্বাচনী বিধি চালু হওয়ার পর থেকেই যে হারে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে, দম ফেলার ফুরসত টুকুও পাইনি। আজ রাতে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমাবো।”